অরুণ কুমার চক্রবর্তী: বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায শান্তিনিকেতনে পড়তে আসেন ১৯১৭ সালে, এবং কলাভবন শুরু হওয়ার পর উনি সেখানে যোগ দেন। একটি লেখায় বিনোদবিহারী লিখছেন- “যখন স্বদেশী আন্দোলনে মুখর সারা বাংলা যখন মানুষের মুখে মুখে “বঙ্গ আমার জননী আমার” তখন আমি কোথাও চুপচাপ বসে ছবি আঁকছি, আমি হয়তো তেমন ভাবে পারিনি সামাজিক দায়িত্ব গুলোকে নিজের কাঁধে তুলে নিতে। যদিও আমি বন্যা দেখেছি, দুর্ভিক্ষ দেখেছি, ভূমিকম্প দেখেছি, ভারত ও পাকিস্তানের সমকালীন ইতিহাস এর পাতাগুলো আমার চোখের সামনে ফুটে ফুটে উঠেছে বারবার, তবু আমি এদের নিয়ে ছবি আঁকতে পারিনি। আমি শুধু নিজেকে জানতে চেয়েছি এবং সেটা করতে গিয়ে নিজেকে মেলে ধরেছি অন্যের কাছে, কিন্তু কখনো ভুলিনি আমি তোমাদেরই একজন”।
বিনোদ বিহারীর ছবিতে মূলতঃ আমরা পাই প্রকৃতি। শান্তিনিকেতনে আসার আগে থেকেই বিনোদবিহারী একটা ঝোঁক ছিল প্রকৃতির প্রতি। ছোটবেলায় অনেকটা সময় তার কেটেছে গ্রামে, পাবনা জেলায়, পদ্মার পাড়ে।
রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের সান্নিধ্যে আসার পর আরও বেশি করে প্রকৃতিকে চিনতেও জানতে শুরু করেন। খোয়াইয়ের জঙ্গল বা কোপাই নদী ছিল ওঁর ছবি আঁকার প্রেরণা। নন্দলালের ভূমিকা ওঁর ছবি আঁকার জীবনে এক বড় সম্পদ, যেখানে নন্দলালের এক অন্য উত্তরণ আমরা দেখতে পাই বিনোদবিহারীর ছবিতে।
১৯২৩ থেকে ১৯৩৭, নন্দলাল যা কাজ করেছেন ( হরিপুরা পোস্টার সহ) সব ক্ষেত্রেই বিনোদ বিহারী কে সহযোগী হিসেবে পেয়ে ছিলেন, ফলে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। বিনোদবিহারীর ক্যালিগ্রাফির প্রতি ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। যদিও তিনি কখনো চিনা পদ্ধতিতে কাজ করার কথা ভাবেননি।
শিল্প হয়ে ওঠে এক কথা বলার ভাষা যা দেখি তা বক্তব্যের সঙ্গে মিশে থাকে তার আকার প্রকার ও স্থান কাল। Stella kramrisch , তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন বিনোদ বিহারীর আঁকার মধ্যে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য শিল্পকলার এক মেলবন্ধন। বিশেষ করে ওঁর কাঠ খোদাইয়ের মধ্যে উনি জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট এর ছায়া দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করেন নন্দলালের সান্নিধ্যে আসার পর পূর্ব এশি়ায় শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি ওঁর বিশেষ মনোনিবেশ, যা ওঁর মননে শৈল্পিক বুদ্ধিদীপ্তর প্রকাশ ঘটায়।
১৯৩৬ – ৩৭ সালে বিনোদবিহারী জাপান ও চীন সফরের পর উনি শুরু করেন গাছ ও ফুলের ছবি আঁকা। যদিও একটি গাছ বা একটি গাছের ডালের ছবি আঁকা কে পশ্চিমী শিল্পধারায় কোন প্রকৃতির ছবি বা কোন স্থিরচিত্র বলে ধরা হয় না। যে সময় নন্দলাল চিনা ভবনের “নটীর পূজা” করছিলেন, সেই সময় বিনোদবিহারী চিনা ভবনের অন্য একটি ম্যুরালের কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে হিন্দি সাহিত্যে “ভক্তি সাধু”দের অবদানের কথা মাথায় রেখে ওঁর করা হিন্দি ভবনের ম্যুরালে আমরা এক সুন্দর কলা মাত্রিক ছন্দ দেখতে পাই।
সেখানে “জৈন মিনিয়েচার” থেকে “পট”, “পারস্য মিনিয়েচার ” বা “ক্যালিগ্রাফি”র এক অন্যন্য সংমিশ্রণ দেখতে পাই। ১৯৪৮ সালে বিনোদবিহারী দুবছরের জন্য কাঠমান্ডুতে যান। নন্দলালের শিল্প ও কারুকলার যৌথ ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট হন বিনোদবিহারী, এর ফলে “বনস্থলী” ম্যুরালটি মধ্যে আমরা পাই সনাতনী ও লোকশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন।
নেপালে থাকাকালীন অন্য কাজগুলোর মধ্যে আমরা পাই লোকশিল্পের সঙ্গে আধুনিকতার এক মিশ্রণ যা মূলতঃ “পোস্ট কিউবিস্ট”। বিনোদবিহারী এক জায়গায় লিখছেন – “মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি, কে আমার প্রকৃত শিক্ষক?- গুরু নন্দলাল, যার কাছে শিখেছি ছবি আঁকার পদ্ধতি, নাকি, যে জ্ঞান আহরণ করেছি গ্রন্থাগার থেকে, নাকি, শান্তিনিকেতনের এই মনোরম পরিবেশের অভিজ্ঞতা, যা আমি ছবিতে লিপিবদ্ধ করেছি!
এক চোখের অপারেশনের পর ১৯৫৭ সালে ওর দৃষ্টিশক্তি চলে যায়, কিন্তু ওঁর গভীর মনের চিন্তার অবসান ঘটে না। উনি ১৯৫৭ – ‘৭০ এর শেষ ভাগ পর্যন্ত প্রচুর শিল্পকর্ম করেছেন অন্ধ অবস্থায়।
সত্যজিৎ রায়ের তৈরি তথ্যচিত্র ” The inner eye” ( 1972) তে এক জায়গায় বিনোদবিহারী বলছেন- ” This is the first time both form and space is a blind man’s space…. যদি তোমার কোন জায়গায় সন্দেহ থাকে …. কিরকম , চোখে তো ভালো লাগেনা, চোখ বুঝতে হবে না, তুমি একটা experience কে … একটা solid portion এ তে …. সেখানে তুমি হাত বুলিয়ে second portion এ আসবে …. Your conception will be quite different than your optical sensetion”.
ফাঁকা মাঠে একটি গাছ ছিল ওঁর নিজস্ব ছবি আঁকা দৃষ্টিভঙ্গি যা ব্যক্তি বিনোদ বিহারীকে উপস্থাপিত করে।