বইপোকা

0
70

সুজয় গুহ

বই পড়ার অদম্য ইচ্ছে বুকে চেপে জিতেনদা হঠাৎ বইমেলায় গিয়েছিলেন। এক গুচ্ছের বই কিনে ফিরেছেন। তাতে ফরাসী, আরবী লেখকের ইংরেজি অনুবাদ বই যেমন আছে, স্থান পেয়েছে কবিতা, সাহিত্য থেকে শুরু করে মার্কস-এঙ্গেলস, এমনকী মমতাময়ী আখ্যান থেকে আধ্যাত্যবাদও, প্রায় হাজার পাঁচেক টাকার তো হবেই।

- Advertisement -

নিজে দাড়িয়ে থেকে কাঠের মিস্ত্রি দিয়ে নতুন ইজি চেয়ার, বসার ঘরে সাত তলা বুকসেল্ফও বানিয়েছেন। নতুন বইগুলি সাজিয়েও এখনও প্রায় তিন তাক ফাকাই রয়েছে ঝা চকচকে বুকসেল্ফ। জিতেনদার পড়ার খিদের কাছে হার মেনে ওই তাকগুলি শীঘ্রই পূর্ণ হবে বলে ধারণা পোষণ করেছে সুহৃদ সম্পর্কের প্রতিবেশীরাও।

একসময় অনেক বই পড়তেন, একথা ঘনিষ্ঠ মহলে জানালেও সেই সুসময়টার কথা কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না জিতেনদা। কোন বই, কোন সে লেখক মনে না থাকলেও, তার যে পড়ার একটা খিদে একসময় ছিল তা মস্তিষ্কে বই পোকার নড়া-চড়ায় বিলক্ষণ অনুভব করলেন।

যাই হোক, অফিস, পরিবার সামলে জিতেনদা বই পড়ার সময় নির্দিষ্ট করলেন। পঞ্জিকা মিলিয়ে শুভ দিনক্ষণ দেখে একদিন তিনি বুকসেল্ফের সামনে গিয়ে প্রসন্ন মুখে সব থেকে মোটা একটি বই তুলে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন। সোনালী ফ্রেমের নতুন চশমায় আইএসবিএন নম্বর থেকে শুরু করে মুখবন্ধ পর্যন্ত পড়ে তিনি থামলেন। নাহ, বই পড়ার উত্তাপ তো তিনি পাচ্ছেন না! প্রতিবেশীর টিভির শব্দ, নিজের ঘরের ফ্যানের শব্দ কি বইয়ের শব্দের ছন্দ পতন ঘটাচ্ছে কিনা তা অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন। আরো দু চার লাইন জোর করে পড়ার পর আবারও থামলেন। নাহ, বইয়ের সম্পাদনায় কোনও ঘাটতি থেকে থাকতে পারে মনে করে জিতেনদা ফের বুকসেল্ফের সামনে এসে দাঁড়ালেন। অন্য লেখকের একটি বই নিয়ে ফের সোফায় বসলেন। না, সমস্যা একই। বই পড়ায় অন্তরের তাগিদ থাকলেও বেশি দূর এগোতে পারছেন না। এরপর সাহিত্য, রাজনীতি থেকে আধ্যাত্যবাদ কোনও কিছুই বাদ গেলো না। এভাবেই জিতেনদা খান চারেক বই বদল করেও পড়ায় মন বসাতে পারলেন না।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জিতেনদার মনটা বড় খচখচ করতে লাগল। বেজার মুখে জিতেনদা বাজার গেলেন। বাজার থেকে ফেরার সময় দেখলেন, আসে পাশে ক্রেতা না থাকায় এক সবজি বিক্রেতা নিশ্চিন্তে একটা বই পড়ছে। জিতেনদা এদিক ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে একথা সেকথায় সবজি বিক্রেতার কতদূর পড়াশোনা থেকে শুরু করে এভাবে কাজের ফাঁকে বই পড়ায় আগ্রহ থাকে কিনা জেনে নিলেন। সবজি বিক্রেতার কথা মতো অফিসে কাজের ফাঁকে একটি বই নিয়ে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলেন। তাই দেখে সহকর্মীরা কেউ বা বাহবা দিলেন, কেউ আবার জিতেনবাবুর জন্মদিনে আরও সুখপাঠ্য বই উপহার দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল।

সব সামলে বিজ্ঞের মত বইয়ের ভাজে মুখ গুজলেন জিতেনদা। বইয়ের পাতার ভারী ভারী শব্দগুলোকে প্রায় একত্রিত করে ফেলেছিলেন এমন সময়, পাশের টেবিলের সাহাবাবুর কীবোর্ডে গোদা আঙুলের ঘটাস ঘটাস শব্দ সহ অফিস পরিবেশের অন্যান্য খুচরো আওয়াজ জিতেনদার জ্ঞান আহরণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। বিরক্ত জিতেনদা বইটা বন্ধ করে কাঠের চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিলেন।

অফিসে কাজের ফাঁকে ঘুমানোর অভ্যাস মোটেই নেই জিতেনদার। কিন্তু ঘুম ভাঙল অফিস অ্যাটেনডেন্টের চায়ের কাপের শব্দে। বিকেল চারটার চা দেখে জিতেনদা বুঝলেন দুপুরের খাওয়াটা তিনি মিস করেছেন। একটু ফ্রেশ হয়ে এসে তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অফিস অ্যাটেনডেন্টের উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়লেন। কাগজের ঠোঙ্গায় এলো দশ টাকার মুড়ি লঙ্কা চপ। ঠোঙ্গাটা হাতে নিয়ে জিতেনদার বইপোকাটা যেনো নেচে উঠলো। এতো নন্টে ফন্টে আর কেল্টুদার কীর্তি ঠোঙ্গার কাগজ জুড়ে। ছোটবেলার লেখক নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্টি ডানপিটে চরিত্রগুলি জিতেনদার মনে পড়ে গেলো।

জিতেনদা ঠোঙ্গা থেকে মুড়ি টেবিলে ঢেলে ফেললেন। এরপর ঠোঙ্গাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়তে লাগলেন। কমিকসে নন্টে ফন্টের কাণ্ডকারখানা পড়তে পড়তে জিতেনদার মুখ দিয়ে হাসির ফোয়ারা ছুটলো। তিনি সশব্দে টেবিল চাপড়ালেন, চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকলেন। অফিস ব্যস্ততার শত শব্দ, সহকর্মীদের হাসাহাসি, জিতেনদার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।