অর্থনৈতিক সংস্কারের আবহসঙ্গীত নাকি শান্তিকামনা

0
185

কৌস্তভদ্যুতি চ্যাটার্জি: ১৯৫৯ সালের মার্চ নাগাদ এক রাতের মিটিং এ “ইকোনমিস্টা” কে “কমিউনিস্ট” ভেবে হাত তোলার ফল টা তখনও না তিনি বুঝেছিলেন যিনি হাত তুলেছিলেন, না তিনি বুঝেছিলেন যিনি সেই হাত তোলা ব্যক্তি, যিনি একজন ডাক্তার, তাঁকে সমগ্র কিউবার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরের গভর্ণর করে দিয়েছিলেন। তারপরের ঘটনা খুব স্বাভাবিক দিকেই মোড় নিল।

বন্দুকের নলের সামনে আমেরিকার প্রাইভেট ব্যাঙ্ক গুলো তাদের ব্যবসা গোটালো কিউবা থেকে। ন্যাশনাল সিটি ব্যাঙ্ক নিউইয়র্ক, ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক বোস্টন (এখনকার ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা), চেজ ম্যানহাটন (এখনকার জে পি মরগান চেজ) সবাই বিদায় নিল কিউবা থেকে। বলা ভাল বাধ্য হল। তখন ইকোনমিক রিফর্মের দরুন সমস্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা সেন্ট্রালাইজ করা হচ্ছে। কিউবান বিপ্লবের পুরোধা সেই মানুষটি সমাজতন্ত্রকে পাথেয় করে “সেন্ট্রাল ইকোনমিক প্ল্যানিং” এর দিকে ঝুঁকেছেন। সঙ্গী ডাক্তার কমরেডের উপর তাঁর অগাধ ভরসা।

- Advertisement -

কিন্তু এই নতুন গভর্ণরের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত অচিরেই সর্বনাশ ডেকে আনল কিউবার ব্যাঙ্কিং সেক্টরে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে কিউবা কে বহিষ্কার করা হল। সঙ্গে কিউবা আইডিবি এবং আইএমএফ এর মেম্বারশিপ ও ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। এই ক্রাইসিস চলল বহুদিন পর্যন্ত এবং যার পরিণামে আমেরিকা এবং কিউবার সম্পর্ক শুধু সাধারণ শত্রুতায় থেমে রইল না, আরও অবনতির দিকে এগিয়ে গেল যা ১৯৬২ সালে জন কেনেডির ব্যবসায়িক দৌত্যের চেষ্টা সত্ত্বেও এতটুকু প্রভাবিত হল না। এতে কিউবার সাধারণ মানুষের ভয়াবহ ভোগান্তি র কোনও শেষ রইল না দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে।

বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত কিউবা কোনও ন্যাশনাল ক্রাইসিসের সময়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাহায্য থেকে ব্রাত্য হয়ে রইল। শোচনীয় দারিদ্র এবং সরকারি চোখরাঙানি র ভয়াবহ পরিস্থিতি র মধ্যে কিউবার জনসাধারণের আর্তি শোনার কেউ রইল না। তাদের আওয়াজ বহির্বিশ্বে পৌঁছল না দীর্ঘ সময় ধরে। অবশেষে এল ২০০৬ সাল, যখন রাষ্ট্রের কর্ণধারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন রাউল কাস্ত্রো এবং ধীরে ধীরে কিউবা বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদের দরজা খুলে দেওয়ার দিকে এগিয়ে চলল।

১৯৫৯ সালের আগে কিউবান পর্যটন শিল্পে বেসরকারি সংস্থা র আধিপত্য ছিল যা ফিদেল কাস্ত্রো র আমলে ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা আবার স্বমহিমায় ফেরা শুরু করল রাউল কাস্ত্রো র সময়ে বেসরকারি সংস্থা দের দরজা খুলে দিয়ে। অবশ্য বেসরকারি লগ্নি এবং তার ভবিষ্যৎ গুরুত্ব শেষ জীবনে ফিদেল ও বুঝেছিলেন, তাই ২০০০ সালেই তিনি মিশ্র-লগ্নি র আশ্রয় নিয়ে হাভানা সহ কিউবার বেশ কিছু শহরের ড্রেইনেজ এবং ওয়াটার সিউয়ার সিস্টেম কে বেসরকারি হাতে দিয়েছিলেন।

সোশ্যালিজমের মোড়কে বেসরকারি লগ্নির শুরু টা ফিদেল নিজেই করে গিয়েছিলেন, হয়তো তাঁর সেই ১৯৫৯ সালে এক রাতের ঐ ভুলের প্রায়শ্চিত্তের জন্য। যা নিয়ে তাঁর খেদোক্তি ছিল – “Why I ever did that, I don’t know, because obviously Che Guevara knew nothing about finance and banking, I put him in there because I guess I trusted him. But it was a mistake.”।

যাইই হোক, নতুন কিউবার উত্থানের মূলে সমাজতন্ত্রের অভিযোজন নাকি ধনতন্ত্রের সূচনা সেই নিয়ে তর্ক হয়ত চলতে পারে, তবে ফিদেল “জলব্যবস্থা র বেসরকারিকরণ” এর সূচনা করে যে রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন দীর্ঘ ৪০ বছর আগের করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ, তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই রাউল পর্যটন শিল্প (মার্চ ২০০৯) এবং রাউলের থেকে রাষ্ট্রের দায়ভার গ্রহণ করা মিগুয়েল দিয়াস রেস্তোরাঁ এবং ফুড ইন্ডাস্ট্রি র বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে (নভেম্বর ২০২০) হয়তো কিউবার নুইয়ে পড়া অর্থনীতি কে নতুন দিশা দেখালেন।

এখনকার নতুন কিউবা ব্যবসায়ে বেসরকারি লগ্নির থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পথে হাঁটতে চলেছে। আগামী দিনের কিউবা তার অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে কতটা এগোবে সেটা বলা না গেলেও, অন্তত আশা টুকু করাই যায়। “কাউন্ট অফ মন্টেক্রিস্টো” তো বলেই গেছেন যে “আমরা শুধু অপেক্ষা করতে পারি, আর করতে পারি আশা”। নয় কি?