জঙ্গলমহল নয়, সল্টলেকেই একবেলা খেয়ে দিন কাটছে অসহায় দম্পতির

0
94

সুমন বটব্যাল, সল্টলেক: চারিদিকে কংক্রিটের ইমারত৷ রাজ প্রাসাদও রয়েছে৷ তারই মাঝে রাস্তার ধারে একফালি ত্রিপলে ঢাকা আচ্ছাদন৷ এটাই ওদের পৃথিবী৷ যেকোনও বড় শহরে এমন বহু আস্তানায় চোখে পড়ে! প্রদীপের তলাতেই তো অন্ধকার থাকবে! তাই না? এতে আর নতুনত্বের কি আছে? হ্যাঁ, আছে৷ সল্টলেকের কেবিকেসিতে খাল লাগোয়া আবাসনের সীমানা পাঁচিলের গা ঘেঁষে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে থাকা এই দম্পতির কাহিনী শুধু করুণ নয়, হৃদয় বিদারক, মর্মান্তিকও বটে৷

৭৬ ছুঁই ছুঁই রুপো সরকার৷ বাম চোখে ছানি পড়েছে৷ ঝাপসা দেখেন৷৷ বয়সের সঙ্গে শরীরে বাসা বেঁধেছে হাজারো ব্যাধী৷ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেন৷ সহধর্মিনীর আবার দু’চোখেই ছানি পড়ে কার্যত অর্থব৷ কান কম শোনেন৷ ঠিক করে কথাও বলতে পারেন না৷ গায়ে গতরে খাটার ক্ষমতা গিয়েছে বৃদ্ধেরও৷ অগত্যা, অন্যের ভরসায় দিন কাটে৷ ব্রেক ফাস্ট, টিফিন শব্দগুলো এখানে বিলাসিতার নামান্তর৷ একবেলা খেয়েই দিনের পর দিন অভুক্ত থাকতে হয় এই দম্পতিকে৷ কেন?

- Advertisement -

রুপোর কথায়, ‘‘আমি ঠিক করে হাঁটতে পারি না? শরীরেও বল নেই৷ স্ত্রীর দু’চোখে ছানি৷ চোখে দেখতে পাই না৷ কানে কম শোনে৷ আমাদের কথা আর কে ভাববে বাবু৷ আগে ওই খালপাড়ে থাকতাম৷ ওখান থেকে হাঁকিয়ে দিল৷ তখন থেকে এই ত্রিপলের ছাউনির তলায় কোনওমতে বেঁচে আছি৷’’ রূপো জানালেন, এলাকার কিছু সহৃদয় মানুষ এগিয়ে আসেন৷ সাহায্য করেন৷ তাঁদের দয়াতেই কোনওদিন একবেলা খাবার জোটে৷ আবার কোনওদিন শুকনো মুড়ি চিবিয়ে দিন পার করতে হয়৷’’ সরকারি সাহায্য? প্রশ্ন শুনে মুখ শুকিয়ে যায় বৃদ্ধর, ‘‘সবাইকে বলেছি৷ কাউন্সিলর, এমএলএ, পার্টির নেতা৷ সব্বাইকে৷ কেউ কিছু দেয়নি৷’’

শুরুর গল্পটা অবশ্য অন্য রকম ছিল৷ ওপার বাংলা থেকে আসা সেদিনের তরুণ সল্টলেক ড্রেনেজ চ্যানেলের পাশে খালপাড়ে আরও অনেকের সঙ্গে গড়েছিলেন নিজের মাটির বাড়ি৷ ঘর বেঁধেছিলেন আরতি সরকারের সঙ্গে৷ স্বামী–স্ত্রী দু’জনে মিলে একসময় গায়ে গতরে প্রচুর খেটেছেন৷ রোজগারও করেছেন৷ কিন্তু নুন আনতে পান্তে ফুরনো সংসারে সঞ্চয় আর করা হয়ে ওঠেনি৷ বছর দশেক আগে খালপাড় থেকে উচ্ছেদ হতে হয় নিঃসন্তান দম্পতিকে৷ তখন থেকেই খালপাড়ের উল্টো দিকে ত্রিপলের ছাউনিতেই বাস! শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, কিংবা আমপান, ইয়াসের মতো রাক্ষুসে ঝড়কে সঙ্গী করেই এগিয়ে চলেছে ওদের বারোমাস্যা৷ এখন গায়ে গতরে খাটার সেই ক্ষমতা গিয়েছে৷ অগত্যা, পরের দয়ায় বেঁচে থাকা৷ অন্ধের ভরসা বলতে প্রতিবেশী স্বামী পরিত্যক্তা দুই সন্তানের মা শিলা মণ্ডল৷

শিলা বলেন, ‘‘দিনের বেলা এখানেই থাকি৷ দাদি, দিদাকে নিজের সাধ্যমত সাহায্য করি৷ তবে আমিও তো অসহায়৷ সরকার থেকে ওদের কিছু একটা ব্যবস্থা করলে ভাল হয়৷’’ কখনও যদি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয় যায়, কি বলবেন দিদিকে? রূপো বলেন, ‘‘কি আর বলব৷ দুটি খাবার চাইব আর থাকার একটু আশ্রয়৷ যাতে শেষ বয়সে বুড়োবুড়ি একটু বাঁচতে পারি!’’

সল্টলেকের বুকে এমন ঘটনা? শুনে চমকে উঠলেন বিরোধীরাও৷ বিজেপি নেতা দেবাশিস জানা বলেন, ‘‘খালপাড় থেকে বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার সময় পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছিল৷ শুনেছি, অনেকে পুনর্বাসন পেয়েওছেন৷ ওই দম্পতি মনে হয় শাসকের পছন্দের তালিকায় ছিলেন না৷ তাই পাননি!’’ দলগতভাবে দম্পতির পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন দেবাশিসবাবু৷ বিধাননগর পুর নিগমের চেয়ারম্যান কৃষ্ণা চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘আপনাদের মুখ থেকেই শুনলাম৷ বিষয়টি আমার জানা নেই৷ তবে ওই দম্পতির সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করা হবে৷ স্থানীয় কাউন্সিলরকে বলব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে৷’’

অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ কিংবা দায়সারা প্রতিশ্রুতি সবই রয়েছে৷ কিন্তু অসহায় নিঃসন্তান দম্পতি কি পাবে পুনর্বাসন? মাথা গোঁজার ছাদ? শেষ বয়সে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান সত্যি কি হবে? সময়েই মিলবে সদুত্তর৷

আরও পড়ুন: দল বদলের হিড়িকে শুধু সাধারণ মানুষের নয়, ক্ষতি হচ্ছে রাজনীতিরও