শিল্পে রবীন্দ্র ভাবনা ও পরবর্তী সময়-১

0
1793

অরুণ কুমার চক্রবর্তী: ১৮৬৯ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গ্রীষ্মের দিনে বীরভূমের লাল মাটির রাস্তা দিয়ে যখন যাচ্ছিলেন তখন তার এই শান্ত পরিবেশকে মনে হয়েছিল “মনের প্রশস্তি ও চিন্তার উদারতা”, যা কলকাতার ভিড় থেকে একদম আলাদা। এর ফল স্বরূপ উনি কিনে ফেললেন একটি জমি যার নাম পরবর্তীকালে রাখলে “শান্তিনিকেতন”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে এখানে শুরু করলেন এক অনন্য ধরার দর্শন ও পরীক্ষা মূলক শিক্ষা কেন্দ্র। পরবর্তী ২৫ বছরে এটি একটি অন্য ধারার শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে।

- Advertisement -

রবীন্দ্রনাথ বহুবার তার এই পরীক্ষামূলক শিক্ষাব্যবস্থাকে এক “কবির স্বপ্ন” হিসেবে উল্লেখ করেন। সংস্কৃতিবান বাংলার অনেকেই এটিকে বাংলার নবজাগরণের ফলশ্রুতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা সেই সময় এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাইছিল যেখানে তাদের ঔপনিবেশিকতা বজায় রাখতে কোন অসুবিধে না হয়। এই সময় গড়ে উঠেছিল এক অন্য ধারার চিন্তা, যেখানে ভারতীয় ইতিহাস ও পরিবেশ তত্বকে নিবিড় ভাবে জানার আগ্রহ তৈরি হচ্ছিল।

বলাবাহুল্য, শিক্ষিত সমাজের চাহিদা হতে থাকে পাশ্চাত্য শিক্ষা যেখানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে মানবিক সহমর্মিতার উন্মেষ গড়ে উঠেছিল ইউরোপীয় নবজাগরণের পরবর্তী সময়ে। এই প্রভাব ভারতবর্ষে ও এসে পড়ে, যেখানে ধর্ম বা সামাজিক মূল্যবোধ পুরনো ধ্যান ধারণার বাইরে ও নতুন কিছু শিখতে এবং ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এইসময় শিক্ষিত সমাজ ও তার নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিরা পুরনো ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন চিন্তার একটি মৌলিক মেলবন্ধনের সূত্র খুঁজতে থাকেন।

প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ ও এইসব ভাবনা গুলির সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে জাতীয়তাবোধের যে ভাবনা উঠে আসছিল তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল জাতিভেদের অন্ধ কুসংস্কার, মানুষে মানুষে বিভেদ যা মুক্তচিন্তা পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের ভাবনার মধ্যে ছিল আধুনিকতা, যা উনি এই সময়ের দ্বন্দ্বমূলক নবচিন্তা ধারাগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। “কবির স্বপ্ন” শান্তিনিকেতন, যত ছোট আকারে হোক না কেন, তার মধ্যে ছিল স্বদেশীকতার মৌলিক চিন্তা ও মুক্তচিন্তার সমন্বয়।

তাই , ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ওঁর ভাবনায় পড়াশুনো যেন কখনো শিশু মনকে ভারাক্রান্ত করে না তোলে। শিশু মনকে গড়ে তুলতে হবে জানার আনন্দ ও প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতিকে চেনার মধ্যে দিয়ে। এর ঠিক দুই দশক পরে এই ছোট্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে “বিশ্বভারতী” এক অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ভারতবর্ষ নয়, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা নিতে আসে, যার মূল উদ্দেশ্য গঠনমূলক চিন্তা ও ব্যক্তিগত সৃজনশীলতার প্রসার ঘটানো। বিশ্বের দরবারে এ এক শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতিক মেলবন্ধন।

অন্তর্মুখী জিজ্ঞাসার এক বহিঃপ্রকাশের মুক্ত রূপ, যা বিশ্বের আঙিনায় ভারতীয় দর্শন কে তুলে ধরে।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের মধ্যে রয়েছে এক সহজাত সৃজনশীলতা ও এক অন্তর্নিহিত শক্তি, যা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে শৈল্পিক অনুপ্রেরণার কাজ করে। এটি একটি অনুশীলন। অন্তরের গভীর উষ্ণতাকে সজীব করে বেঁচে থাকার আগ্রহকে আরও নিবিড় করে।

রবীন্দ্রনাথ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সৃজনশীল কোন কিছু লক্ষ্য করলে তাকে আরো বেশি করে উৎসাহিত করতেন। এর মধ্যে ছবি আঁকা, লেখা, গান, অভিনয়, নৃত্য এবং আরো অন্যান্য সৃষ্টিশীল মাধ্যমগুলিকে কে ওঁর ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে যুক্ত করেন।

রবীন্দ্রনাথ এই শিক্ষণ প্রণালীর প্রবক্তা হিসেবে এক উদাহরণ স্থাপন করেন।গোড়া থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সঙ্গে গান, লেখা, সুর করা এবং নাটক, যা পরবর্তীকালে তিনি নিজে অভিনয় করে দেখাতেন। লেখার সঙ্গে আঁকিবুকি করার এক সফল প্রয়োগ ঘটাতে থাকেন, যা পরবর্তীকালে এক অসামান্য চিত্র ধারার উপহার আমরা ওঁর ছবিগুলির মধ্যে থেকে পাই। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন শিল্পকলা ছাড়া কোন শিক্ষাই সম্পূর্ন নয়।

১৯১৮ সালে কলাভবনের প্রতিষ্ঠার পর তার দায়িত্বভার তুলে দেন শিল্পী নন্দলাল বসুর হাতে। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনে ভারতবর্ষে প্রথম শিল্পকলা শিক্ষা শুরু হয়।

অরুন কুমার চক্রবর্তী, শিল্পী
কর্ণধার, রেখা চিত্রম