নতুন রাহুল গান্ধীর আবির্ভাব

0
81
Rahul Gandhi

যোগেন্দ্র যাদব: উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক কিছুই পেয়েছেন রাহুল গান্ধী(Rahul Gandhi)। এটা শুধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বা কংগ্রেস দলের নির্বাচনী ভাগ্যের জন্য সুসংবাদ নয়। এটি সারা ভারতের ভবিষ্যতের জন্য সুখবর হতে পারে।

এই সপ্তাহে দেশ দেখল নতুন রাহুল গান্ধিকে(Rahul Gandhi)। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে রাফায়েল কেলেঙ্কারিতে তাঁর একক এবং তীক্ষ্ণ আক্রমণের বিপরীতে, আদানির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর জড়িত থাকা নিয়ে তাঁর সওয়াল একবারে তীক্ষ্ণ এবং শান্ত ছিল। সেগুলি ধ্রুপদী বাগ্মীতা নয় ঠিকই। কিন্তু তিনি ক্ষমতাসীন দলের হোমড়া-চোমড়াদের বিরুদ্ধে সবল আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছেন যে তাঁর কাছে মামলার তথ্য রয়েছে এবং তাঁর পেছনে নিজের দল এবং জনসাধারণ রয়েছে সমর্থন করার জন্য। এই আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য দরবারি মিডিয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এটি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট যে আদানি-মোদি জোটের অভিযোগ অনেক দূর যেতে চলেছে।

- Advertisement -

আমি এই নতুন রাহুল গান্ধীকে(Rahul Gandhi) আগেই দেখেছি। যদি আপনি একটি তারিখ চান, আমি ৩০ জানুয়ারির কথা বলব। সেদিন ভারত জোড়ো যাত্রার সমাপ্তি অনুষ্ঠান। “শেষ জনসভার সময় বৃষ্টি বা তুষারপাতের সম্ভাবনা ছিল ৯০ শতাংশ”, রাহুল গান্ধির ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাইজু কয়েকদিন আগে আমাকে জানিয়েছিলেন। এবং পূর্বাভাস যথেষ্ট সঠিক। শ্রীনগর আগে থেকেই হিমশীতল ঠান্ডা। ভোরের দিকে প্রবল তুষারপাত শুরু হয়। যখন স্টেডিয়ামে পৌঁছলাম, তখন আমাদের তুষার, হিম এবং কাদার মধ্য দিয়ে হেঁটে মঞ্চে যেতে হল। সভা শুরু হওয়ার পর তুষারপাত বাড়তে থাকে।

আমার বরফজুতো ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছিল। হিমায়িত জলে ভিজে গিয়েছিল আমার পা। আমি আবিষ্কার করলাম যে আমার নতুন অভিনব গরম জ্যাকেট (মাইনাস ৫ ডিগ্রি সহ্য করার গ্যারান্টিযুক্ত) কিন্তু বৃষ্টিরোধী নয়। মঞ্চ ঢাকা ছিল না। রাহুল গান্ধী(Rahul Gandhi) আদেশ দিয়েছিলেন যে জনসাধারণের জন্য যদি কোনও আচ্ছাদন না থাকে, তবে নেতাদের জন্যও কোনও ঢাকার ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়। দেখা গেল যে কয়েক শতাধিক লোক যারা সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সাহস দেখিয়েছে, তারা নেতাদের চেয়ে স্মার্ট। কারণ তাদের বেশিরভাগই শক্ত ছাতা নিয়ে এসেছে। তাই সমগ্র নেতৃত্ব, যাঁদের মধ্যে অনেকেই তামিলনাড়ু থেকে এসেছেন, তাঁরাই প্রথম তুষারপাতের সৌন্দর্য অনুভব করেছেন। রাহুল গান্ধি বক্তাদের সংখ্যা কমানোর যে কোনো পরামর্শ বাতিল করেছেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর এল তাঁর কথা বলার পালা।

মঞ্চে পৌঁছে তিনি প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হল বক্তার জন্য ছাতা ধরে থাকা ব্যক্তিকে সরিয়ে দেওয়া। তারপরে কথা বললেন শান্তভাবে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে আস্তে আস্তে। সদ্য সমাপ্ত যাত্রার উদ্দেশ্য নিয়ে বললেন। একথাও বললেন কীভাবে এই যাত্রা তাঁর অহঙ্কারকে কমিয়ে দিয়েছে, শারীরিক শক্তি নিয়ে তাঁর গর্ববোধ হয়েছে এবং কীভাবে এক অল্পবয়সী মেয়ের চিঠি তাকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দিয়েছে। কাশ্মীরি ফিরেন এবং টুপি পরা অবস্থায় তিনি বললেন তাঁর টি-শার্ট সম্পর্কে এবং কীভাবে তিনজন পথশিশুর সঙ্গে দেখা করে ঠান্ডা মোকাবেলার সংকল্প নিয়েছেন। তাঁর পরিবারের কাশ্মীর সংযোগ এবং আসাম, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সঙ্গে কাশ্মীরের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য কীভাবে মিশ্রিত হয় সেই বিষয়েও তুলে ধরলেন।

তিনি পকেট থেকে ফোন বের করলেন এবং তাঁর জীবনে ফোন কলের অর্থ কী – তা নিয়ে বক্তব্য রাখলেন। স্কুল জীবনে একটি ফোন কল তাঁর ঠাকুমার নিহত হওয়ার খবর এনেছিল। কলেজ জীবনে একটি ফোন কলে তাঁর বাবাকে হত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিল। তিনি এমন অনেক ফোন কলের কথা বললেন যা নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত আমাদের জওয়ানদের সন্তান বা কাশ্মীরের নানা সাধারণ পরিবারের কাছে যায়। তিনি বলেন, এই যাত্রার উদ্দেশ্য এমন সব ফোন কল বন্ধ করা। এই কথার মধ্যে কোনো অতিনাটকীয়তা ছিল না, গলার স্বরের কোনো ওঠানামা ছিল না। তাঁর বক্তৃতায় কোনো বাগ্মীতা একেবারেই ছিল না। মোদি-শাহ-দোভাল যে এই ফোন কলের আঘাত কখনই বুঝতে পারবে না, তার একটি ক্ষণস্থায়ী রেফারেন্স ছাড়া খুব কম ‘রাজনৈতিক’ বিষয়বস্তু ছিল। কোনো রাজনৈতিক কৌশল ছিল না, বিরোধীদের ওপর চৌকস আক্রমণ ছিল না, চতুর জুমলা ছিল না। যাত্রার পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কিত বহু প্রতীক্ষিত ঘোষণার কোনও চিহ্ন ছিল না, এমন কিছু যার জন্য আমরা অনেকেই অপেক্ষা করছিলাম। বরাবরের মতো, যখন সবাই আশা করেছিল যে তিনি অন্য কিছু বলবেন, তিনি বক্তৃতা শেষ করলেন।

ঠান্ডায় জমাট বাঁধা সেই দিনে রাহুল গান্ধী এমন সহজ এবং উষ্ণ ভালোবাসা অফার করেছিলেন যা উপত্যকার ভিতরে এবং বাইরের প্রতিটি ভারতীয়ের মনে গেঁথে যায়। ভারত কী হতে পারত এবং এখনও হতে পারে তার একটি দৃষ্টিভঙ্গি তিনি এমন সরলতার সঙ্গে তুলে ধরেন যা কেবল মনের অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং স্বচ্ছতা থেকেই আসতে পারে। তিনি সেই উষ্ণতা প্রকাশ করেছিলেন যা কেবল হৃদয়ের বিশুদ্ধতা থেকে উদ্ভূত হতে পারে। তিনি শান্তভাবে কথা বলেছিলেন যা গভীর সংকল্পকে প্রতিফলিত করেছে। প্রায় ৩,৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রা শেষে রাহুল গান্ধি যে এই ভাষণ দেবেন তা আমি আশা করিনি বা চাইওনি। তবুও এক ঝলকানিতে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে স্ক্রিপ্টে লেখা বক্তৃতার চেয়ে এটি অনেক সাবলীল ।

এটা আমার জন্য রাহুল গান্ধীর(Rahul Gandhi) আবির্ভাবের মুহূর্ত ছিল।

হাস্যকরভাবে, পাপ্পু ইমেজ রাহুল গান্ধির(Rahul Gandhi) সবচেয়ে বড় সম্পদে পরিণত হয়েছে। কার্টুন এতটাই পথ রোধ করেছিল যে রাহুল গান্ধীকে সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসতে হয়েছে ছবি এবং ব্যক্তি রাহুল গান্ধীর মধ্যে অমিল সবার মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য। পাপ্পু দিল্লির একজন ক্লাসিক ‘বাবালোক’ যে এই দেশের তাপ এবং ধুলো একদিনও সহ্য করেনি। প্রথম কয়েক দিন ২৫ কিলোমিটার করে হাঁটার খবর এই ছবিকে টুকরো টুকরো করার জন্য যথেষ্ট ছিল। রাহুল গান্ধী আসলে হাঁটছেন না, এমন একটি নিচু মানের মিথ্যা কথা বলা ছাড়া বিখ্যাত আইটি সেলের আর কোনো উপায় ছিল না। পাপ্পু কারও সঙ্গে কথা বলতে রাজি ছিল না। রাহুল গান্ধীর হাত ধরে সকলের সঙ্গে কথা বলা এবং আলিঙ্গন করার প্রচুর ফটো এবং ভিডিও সেই মিথ্যাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। অবশেষে, পাপ্পু ছিল সেই বোকা যে আমাদের দেশ এবং জনগণ সম্পর্কে কিছুই জানত না। তার বিপরীত ছবি এই যাত্রায় রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা হওয়া শত শত সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে উঠে এসেছে। পাপ্পু ভাবমূর্তি প্রচারিত থাকার কারণে রাহুল গান্ধীর বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা দেখে প্রায় সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। পাপ্পু তার ভাবমূর্তি নির্মাতাদের পাল্টা জবাব দিল।

অবশেষে পোস্টার থেকে সরে দাঁড়ালেন আসল রাহুল গান্ধী(Rahul Gandhi)। যাঁর রয়েছে গভীর আত্মবিশ্বাস। যিনি সত্যিকারের অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক সাম্যের সাংবিধানিক আদর্শে বিশ্বাস করেন। একজন চিন্তাবিদ যিনি দেশ এবং বিশ্বের সমস্যাগুলি কেবল তুলে ধরেন না, বরং এক সংবেদনশীল মনের অধিকারী ব্যক্তি যিনি সমস্যার মোকাবিলা করতে পারেন। একজন মানবিক নেতা যিনি ক্রমাগত সহমর্মিতাকে অনুসরণ করেন, যিনি ঘৃণাকে জয় করতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। একজন রাজনীতিবিদ যিনি ক্ষমতার জন্য ক্ষুধার্ত নন। একজন সোজাসাপ্টা ব্যক্তি যিনি নাটক এবং মিথ্যাকে পরিত্যাগ করেছেন। বিপরীতে নরেন্দ্র মোদি যেটা করতে অপারগ।

তবুও এই সমস্ত গুণাবলীর সম্ভাব্য উল্টো দিক রয়েছে। প্রত্যয় অনমনীয়তায় পরিণত হতে পারে। দূরদৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে অতি-জাগতিক। তপস্যার নিজস্ব অহংকার থাকতে পারে। ক্ষমতার প্রতি লোভের অনুপস্থিতি ক্ষমতার ইচ্ছার অভাবে অধঃপতিত হতে পারে। এটাই নৈতিক রাজনীতির চ্যালেঞ্জ।

একজন স্বপ্নদর্শী তখনই রাজনৈতিক বাস্তবতার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নেন, যদি নৈতিকতাকে রাজনৈতিকভাবে কার্যকর করার উপায় না থাকে। রাহুল গান্ধী তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, প্রকৃতপক্ষে সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি এখন কংগ্রেস নেতা, কংগ্রেস কর্মী এবং ভারতের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কংগ্রেসকে তার আত্মার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ক্ষমতার ক্ষুধা না থাকা একটি গুণ, কিন্তু সঠিক কারণে ক্ষমতার ইচ্ছা না থাকা আদতে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। রাহুল গান্ধী তাঁর নিজের দলের মধ্যে নতুন অর্জিত মর্যাদা ব্যবহার করে এটিকে এক দক্ষ নির্বাচনী যন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলার এবং বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এমন একটি বিশ্বে, যেখানে সবাই বিশ্বাস করে যে জনসাধারণকে প্রভাবিত করার জন্য আপনাকে মিথ্যা বলতে হবে, রাহুল গান্ধি এমনভাবে সত্য কথা বলার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন যা স্পর্শ করে জনগণের হৃদয়।

রাজনীতি কেবল মহৎ গুণাবলীর পতাকা ধরে রাখা নয়। আমরা যে বাস্তব, অগোছালো বিশ্বে বসবাস করি সেখানে ওই সমস্ত গুণের প্রয়োগ দরকার। এটা শুধু রাহুল গান্ধী বা কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ নয়, এটা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানো প্রত্যেকের জন্যই চ্যালেঞ্জ। দেশ যখন নতুন রাহুল গান্ধীকে(Rahul Gandhi) আলিঙ্গন করছে, তখন এই অন্ধকার সময়ে রাজনীতির চ্যালেঞ্জ তিনি অস্বীকার করতে পারেন না।