শিল্পে রবীন্দ্র ভাবনা ও পরবর্তী সময় ৩

0
902

অরুণ কুমার চক্রবর্তী: নন্দলাল বসু ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত গুণী এক ছাত্র। অবনীন্দ্রনাথ ও হ্যাভেলের শিল্প পদ্ধতির দ্বারা নন্দলাল যথেষ্ট আকৃষ্ট হয়েছিলেন। শুরুতে নন্দলাল গুরু অবনীন্দ্রনাথের ধারাতেই ছবি আঁকতেন। কিন্তু শান্তিনিকেতনে আসার পর তিনি বুঝলেন ওঁর প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ এবং যা ওঁর নিজস্ব শিল্প পদ্ধতিতেই তার প্রকৃত রূপ ফুটে উঠতে পারে। যার মধ্যে পাওয়া যায় অন্য ধারার এক জাতীয়তাবোধের দর্শন। তাই নিছক অনুকরণ করার থেকে উনি বিরত হন। আনন্দ কুমারস্বামীর কাছ থেকে জানতে পারেন ভারতীয় শিল্পকলার ঐতিহ্য ও তার আদি সংস্কৃতি।

১৯০৯ – ১০ সালে অজন্তা গুহা চিত্র দেখার পর নন্দলালের আঁকার পদ্ধতি বদল ঘটে, যা আমরা ওঁর শিব ও সতি, জতুগৃহ, পার্থসারথি, ছবির মধ্যে দেখতে পাই ।

- Advertisement -

রবীন্দ্রনাথের দ্বারা অনুপ্রাণিত নন্দলাল নতুন করে ভাবতে শুরু করেন কিভাবে মানুষের মাঝে শিল্পকে নিয়ে আসা যায়, বা মানুষের মধ্যে মিশে থাকবে শিল্প। শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নিচে আমরা পাই ভাস্কর্য প্রদর্শনী, এক অর্থে প্রকৃতির মাঝে প্রদর্শনশালা।অঙ্কন শিল্প, ভাস্কর্য, ছাড়াও নন্দলালের আমলে ছাপাই কর্ম বা প্রিন্টমেকিং এর প্রচলন শুরু হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সহজ পাঠ” এ আমরা পাই নন্দলালের ছাপাই কর্মের এক অতি সুন্দর নিদর্শন। সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীর অন্যান্য দিকগুলির চর্চা শুরু হয়- যেমন কাঠখোদাই, তাঁত বোনা, কারপেট বানানো, বাটিক, আলপনা ও চামড়ার কাজ।

এর থেকেই আমরা পাই এক অন্য শিল্পী ও শিক্ষক নন্দলাল বসু কে। নন্দলালের দুই কৃতী ছাত্র বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর ছাড়াও পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা আজও সেই সব ধারা গুলি কে বহন করে চলেছেন।

আনন্দ কুমারস্বামী এবং ওকাকুরার ভাবনায় অনুপ্রাণিত, নন্দলাল কে রবীন্দ্রনাথ পরিবেশ পরিবৃত শিল্প প্রথায় এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন এবং করেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা, পরিশেষে ছিলেন গান্ধীজী। ১৯৩৬ সালে গান্ধীজীর ডাকে নন্দলাল ফৈজপুরে যান শহরটিকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য। সেখানকার গ্রামীণ হস্তশিল্প দিয়ে তিনি সাজিয়ে ফেললেন উপনগরটিকে।

গান্ধীজী অত্যন্ত খুশি হয়ে পরের বছর নন্দলাল কে ডেকে নিলেন এক গ্রামীণ প্রদর্শনীর আয়োজন করতে।
নন্দলাল সারা শহর থেকে পট শিল্প কর্ম দিয়ে সাজান , যা পরে “হরিপুরা পোস্টার” নামে খ্যাত হয়েছিল।
শান্তিনিকেতনে থাকার সময় নন্দলাল সাঁওতালদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে “শবরী” চিত্রগুলি আঁখেন।

কখনো তিনি অন্য ধারায় “সুজাতা”, “রাধার বিরহ” বা “অর্জুন” এর মত পৌরাণিক চরিত্র গুলিকে চিত্রায়িত করেন। আপার “প্রতীক্ষা”র মত ছবি, যা উপলব্ধি করার এবং বাস্তবধর্মী। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করার মতো ওর আঁকা চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গার ছবি। যেমন: অলকানন্দা, হাজারীবাগ, মায়াবতী আশ্রম, লালবাগ, গোয়ালপাড়া – এক অন্য মাত্রা এনে দেয়।

নন্দলালের আকার মধ্যে একদিকে আমরা পাই প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে পশ্চিমী বাস্তবতা , আর অন্যদিকে চিনা অংকন পদ্ধতিতে স্থান ও বিস্তারের বৈচিত্র। শান্তিনিকেতনে “শ্যামলী” বা “কালো বাড়ির ” স্থাপত্য বা রিলিফের কাজের মধ্যে আছে নন্দলালের ভাবনা। মাটির স্থাপত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে উঠেছে রিলিফের কাজ বা, ১৯৪২ সালে চিনা ভবনের বারান্দায় নন্দলাল তৈরি ম্যুরাল, ” নটীর পূজা”।

নন্দলালের এক লেখায় তিনি বলছেন – সৌন্দর্যবোধ আর পরিচ্ছন্ন ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে কোন বিশেষ পদ্ধতির দরকার হয়না , তুমি যদি রং চাপাও কোন সাদা কাগজে সেটাই হবে সেই শিল্পীর আঁকার পদ্ধতি, যখনই তুমি মাটির ওপর তোমার আঙ্গুলের চাপ দেবে তখনই দেখবে তুমি পেয়ে গেছো মূর্তি গড়ার পটুতা।

নন্দলাল সব সময় ভাবতেন সার্বিক এক শিল্প চর্চা কেন্দ্রের কথা। সেখানে শিক্ষার্থীরা পাবে শিল্পশিক্ষার বই, হবে বিভিন্ন শিল্প কেন্দ্রিক আলোচনা এবং পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত হবে উৎসব ও শিল্প শিক্ষা। থাকবে একটি বাৎসরিক শিল্প প্রদর্শনী। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসু শুরু করেন তার এই সকল প্রয়াস।

নিজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে নন্দলাল তার এক ছাত্র কানাই সামন্তকে পত্রে লিখছেন (১৯৫৪) – “আমার ছবির মধ্যে এখানে সেখানে যে উৎসাহী মেজাজ দেখা যায় তা গুরু অবনীন্দ্রনাথের ছবির মধ্যে দেখা যায় না….. এ আমার জাতীয়তাবোধের আত্মিক বহিরপ্রকাশ, এখন আর আমার মধ্যে খুঁজে পাইনা; আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে এই আত্মিক বহিরপ্রকাশ, শৈল্পিক রসবোধের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় …… পরজন্মে আমি প্রার্থনা করি শ্রী বিশ্বকর্মার কাছে, তিনি যেন আমায় সব রকম শৈল্পিক রসবোধের ধারক করে তোলেন।”

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বিমূর্ততার প্রতি নন্দলালের ঝোঁক দেখতে পাওয়া যায়।শারীরিক অসুস্থতার জন্য চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে, কিছু বিশেষ সরল অঙ্কন ধারাকে নিয়ে ওঁর ছবি হয়ে ওঠে সকলের প্রিয়।

ছবির নিজস্ব বক্তব্য হয়ে ওঠে এক শিক্ষণীয় ভাষা যা সরল উপস্থাপনা গ্রহণযোগ্যতা পায় সমকালীন মানব জীবনে।

অরুন কুমার চক্রবর্তী, শিল্পী
কর্ণধার, রেখা চিত্রম