ইতিহাসের পাতায় ‘স্বতন্ত্র’ ঋতুপর্ণ

0
2122

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা: বাংলা সিনেমার ভাষা পরিবর্তনের কাণ্ডারিদের মধ্যে যে নামগুলো উঠে আসত তাঁর মধ্যে অন্যতম হলেন তিনি। তাঁর ছোঁয়ায় সাধারণ গল্পও রূপ পেত অসাধারনত্বে। পাশাপাশি ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সঙ্গে বাংলার মানুষের তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে যে এক রক্ষণশীল মানসিকতা ও ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন তিনি। যে বাঙালিরা এই তৃতীয় লিঙ্গকে ‘কু-চোখে’ দেখতেন তাঁরাই সিনেমা হলের সামনে তাঁর সিনেমা দেখার জন্য লাইন দিতেন। ভগবানের পরিহাস।

আরও পড়ুন- কর্মে অবিচল নন্দিত-নিন্দিত মাদার টেরেসা

- Advertisement -

হ্যাঁ ব্যক্তিটি যদি হন ঋতুপর্ণ ঘোষ তো তাঁর জন্য এই উন্মাদনা খুব স্বাভাবিক। ১৯৯৪ সালে বাংলা চলচ্চিত্র যুগে তাঁর পথ চলা শুরু। শুধু বাংলা নয় অন্যান্য ভাষাতেও সাবলীল তাঁর বিচরণ। তাঁর এই সিনেমার পালা শেষ হয় ২০১৩ সালে। এই ১৯ বছরে তাঁর ফসল ১৯টি সিনেমা। শুধু সিনেমা বললে ভুল বলা হবে, এক একটা অধ্যায়।

‘হীরের আংটি’ দিয়ে তিনি বাংলা সিনেমায় পদার্পণ করেছিলেন। পরিচালক হিসেবে ‘চিত্রাঙ্গদা’য় শেষ হয় তাঁর স্বল্প পরিসরের যাত্রা। অসম্পূর্ণ রেখে গিয়েছিলেন তাঁর শেষ কীর্তি ‘ব্যোমকেশ বক্সী’। শুধু পরিচালক হিসেবে নন, অসাধারণ ছিল তাঁর অভিনয়ের গুণ। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, ‘মেমোরি ইন মার্চ’ ও ‘চিত্রাঙ্গদা’য় তাঁর অসাধারণ অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকরা।

তাঁর ১৯টি ছবির মধ্যে ১২টি সিনেমাই জিতে নিয়েছিল জাতীয় পুরস্কার। প্রত্যেকটি ছবিই স্বতন্ত্র। একটি সিনেমার সঙ্গে মিল নেই অপর সৃষ্টির। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের পরবর্তী যুগে বাংলা সিনেমাকে এক অন্য বাঁকে ত্বরান্বিত করেছিলেন তিনি।

দেশ তথা বিশ্বের চলচ্চিত্র জগতে অন্যতম নক্ষত্র ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সিনেমার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবি তাঁর প্রতিটি সিনেমায় ভীষণভাবে স্পষ্ট। নাচ-গান না রেখেও, আউটডোর শ্যুট না করেও যে একটি সফল বাণিজ্যিক ছবি করা যেতে পারে, সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ।

২০১৩ সালে হঠাৎই আমাদের ছেড়ে চলে যান তিনি। আর বাংলা সিনেমা জগতে তৈরি হয় এক অপূরণীয় ক্ষতি। ১৯৬৩ সালের আজকের দিনে কলকাতায় জন্ম হয় এই মহান তারকার। তাঁর বাবা-মা উভয়েই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র-নির্মাতা ও চিত্রকর।

ছোটবেলা থেকেই সিনেমার পরিসরে বড় হয়ে ওঠা। ধীরে ধীরে সেই মানসিকতার এক দৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠা। তাঁর কর্মজীবন শুরু বিজ্ঞাপন দিয়ে। তাঁর কলমে অনেক বিজ্ঞাপন মানুষের মনে দাগ কেটেছিল। ঋতুপর্ণের হাত ধরেই বাংলা বিজ্ঞাপন জগতে এসেছিল এক বিপ্লব। ইংরেজি-হিন্দির অনুবাদ নয়, এসেছিল স্বতন্ত্রতা।

সম্পাদনা ও সঞ্চালনাও করেছেন তাঁর এই স্বল্প পরিসরের জীবনে। তাঁর অসামান্য ছোঁয়া রেখে গেছেন প্রতিটি আঙ্গিকে। তাঁর অনুপ্রেরণায় আজও বাঙালি চলচ্চিত্র প্রেমীরা উৎসাহ পান স্বতন্ত্র সৃষ্টিতে। আর তাঁর এই স্বতন্ত্রতাই তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে দিয়েছে।