এই আচারগুলি ছাড়া বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো অসম্ভব

0
86

বিশ্বদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়: দুর্গাপুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। খুব স্বাভাবিকভাবেই দুর্গাপুজোর একেকটি অংশ বা একেকটি আচার (Rituals of Durga Puja) বাঙালির কাছে আলাদা আলাদাভাবে একেকটি পার্বণের তুল্য। আমরা চোখ রাখব এমনই কয়েকটি আচারে (Rituals of Durga Puja)। যা দুর্গাপুজোর কার্যত অবিচ্ছেদ্য অংশ।

(১) মহালয়া: মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ অমাবস্যা। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, দিনটিতে পিতৃপুরুষের অক্ষয় স্বর্গ লাভের কামনা করে তর্পণ করা হয়। তখন জল পেতে এই পৃথিবীতে সমস্ত আত্মার যে সমাবেশ ঘটে, তাকেই বলে ‘মহালয়া’। পুরাণ মতে, কর্ণ এই দিনে মৃত্যুর পর পৃথিবীতে ফিরে এসে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জল দিয়েছিলেন। যদিও দিনটির একটি অন্য তাৎপর্য তৈরি করেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মহালয়ার ভোরে রেডিওতে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে চন্ডীপাঠ শুনেই শ্রেষ্ঠতম উৎসবে মেতে ওঠার প্রথম ধাপে পা দেয় বাঙালি।

- Advertisement -

(২) বোধন: ষষ্ঠীতে দেবী দুর্গার বোধন হয়। বোধন অর্থে দেবীকে জাগ্রত করা। এই সময় দক্ষিণায়ন চলে। যা পুরাণ মতে, দেবতাদের রাত হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণেই দেবীকে ঘুম থেকে জাগ্রত করা হয়। বোধন দিয়েই দুর্গাপুজো কার্যত শুরু। বোধনের সময় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় দেবীর। ত্রেতাযুগে রাবণ বধের উদ্দেশ্যে রামচন্দ্র ষষ্ঠীতে-ই দেবীর অকালবোধন করেছিলেন।

আরও পড়ুন: সপ্তমীর সকালে স্নান করানো হয় কলাবউ বা নবপত্রিকাকে, আসলে কে তিনি

(৩) নবপত্রিকা স্নান: গণেশের পাশে অবস্থান করার কারণে আমরা মনে করি নবপত্রিকা বা কলাবউ হলেন গণেশের স্ত্রী। আসলে কলাবউ গণেশের স্ত্রী। তিনি হলে মা দুর্গার একটি বিশেষ রূপ। শাস্ত্র মতে, মা দুর্গা স্বয়ং প্রকৃতি। তাই দুর্গাসপ্তমী’র সকালে প্রকৃতির কোল থেকে সংগ্রহ করে আনা নব পত্রিকা অর্থাৎ ৯টি উদ্ভিদ— কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু এবং ধানকে স্তনস্বরূপ দুটি বেলের সাথে শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে একত্রে বেঁধে লালপেড়ে গরদের শাড়ি পড়িয়ে একটি বাঙালী বধূর আকার দেওয়া হয়। সেটিকে নিকটবর্তী নদী বা জলাশয়ে স্নান করিয়ে মন্ডপে গণেশর পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।

Rituals of Durga Puja

(৪) অষ্টমীর অঞ্জলী: দুর্গাপুজোর প্রধান দিন বা অশুভ শক্তি বিনাশের পবিত্রতম দিন মনে করা হয় মহাষ্টমীকে। কারণ পুরাণ মতে, এই দিনেই মহিষাসুরকে বধ করতে দেবীকে অস্ত্র প্রদান করেছিলেন দেবতারা। ফলতঃ মহাষ্টমীর দিন দেবীকে অঞ্জলী দেওয়ার প্রথা প্রচলিত বাঙালির মধ্যে। অবশ্য শুধুই অঞ্জলী নয়, অঞ্জলীকে উপলক্ষ্য করে চলতে থাকে প্রেমপর্ব। মায়ের পায়ে ফুল ছুঁড়ে দেওয়ার ছলে টুক করে ফুলটা পছন্দের মানুষকে ছুঁড়ে দেওয়া কিংবা মন্ত্রোচ্চারণের ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তাকানো— এসব চলতেই থাকে। অষ্টমীর অঞ্জলীর সাজ হল, পাঞ্জাবি আর শাড়ি।

(৫) কুমারী পুজো: দেবী মহামায়া একাধিক ক্ষেত্রে বালিকার রূপ ধারণ করেছেন। মূলতঃ এ কারণেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন—”শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ।” এছাড়া একাধিক শাস্ত্রেই বলা আছে, অনধিক ষোলো বছরের যেকোনও অজাতপুষ্প সুলক্ষণা— অরজঃস্বলা কুমারীকে যে কোনও শক্তিপুজোর অঙ্গস্বরূপ আরাধনা করা যাবে। দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী তিথিতে হয় এই কুমারী পুজো। এ পুজোয় শ্রেণী-বর্ণের ভেদাভেদ নেই। এমনকি উপযুক্ত লক্ষণ থাকলে বেশ্যার কন্যাকে-ও ‘কুমারীপুজো’ করা যেতে পারে। বেলুড় মঠের কুমারী পুজো জগদ্বিখ্যাত।

Rituals of Durga Puja

(৬) সন্ধি পুজো: সন্ধির অর্থ, মিলন। দেবী কৌশিকীর ভ্রুসন্ধি থেকে চামুণ্ডার জন্ম। আর দুই তিথির মিলনক্ষণে দেবী রক্তবীজের রক্ত পান করেছিলেন বলেই মহাষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট এবং মহানবমীর প্রথম ২৪ মিনিট মিলিয়ে মোট ৪৮ মিনিটের সন্ধিপুজো আয়োজিত হয়। শাস্ত্রানুযায়ী, দুর্গোৎসবের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘সন্ধিপুজো’ই। কথিত, সারাদিন উপবাসী থেকে ‘সন্ধিব্রত’ করলে নাকি মৃত্যুর পর যম ছুঁতে পারেন না। অন্যদিকে পন্ডিতেরা এও বলেন, এসময় মা দুর্গার অন্তর থেকে সমস্ত মায়া-মমতা মুছে হয়ে যায়, বিনাশকারী ‘চামুণ্ডা’তে রূপান্তরিত হন, তাই তাঁর চোখের সন্মুখে দাঁড়াতে নেই। অষ্টমীতে বলিদানের নিয়ম নেই, সন্ধিক্ষণের প্রথম ২৪ মিনিট পেরোনোর পর নবমী পড়লে তবেই প্রথম বলি হয়। সন্ধিপুজোর অন্যতম প্রধান দুই উপকরণ হল ১০৮টি পদ্ম এবং ১০৮টি মৃৎপ্রদীপ।

(৭) ধুনুচি নাচ: ধুনুচি নাচ দুর্গাপুজোর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ (Rituals of Durga Puja)। এর পৌরাণিক কোনও ব্যখ্যা নেই। বাঙালি মনের আনন্দে উৎসবে মেতে উঠতেই ধুনুচি হাতে নেচে থাকেন। পুরুষ-নারী ভেদাভেদ নেই। যে কেউই নাচতে পারেন। ধুনুচি নাচের পৌরাণিক ব্যখ্যা না থাকলেও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। শরৎ-হেমন্তে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়ে। এদের হাত থেকে বাঁচতেই কর্পূর, নারকেলের ছোবড়া আর ধুনো জ্বালানো হয়। উৎসবে যা একটি বাড়তি মাত্রা লাভ করে। কোনও কোনও পুজো মণ্ডপে ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতাও আয়োজিত হয়।

খাস খবর ফেসবুক পেজের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/khaskhobor2020/

(৮) সিঁদুর খেলা: দশমীতে প্রথমে দেবীর বিসর্জন হয় ঘটে। এই বিসর্জনের পর দেবী দুর্গাকে সিঁদুর, মিষ্টি আর পান-সুপারি দিয়ে বরণ করেন সধবা মহিলারা। বরণের পর এই মহিলারা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। তাঁরা একে অপরকে সিঁদুর মাখিয়ে একে অপরের সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় কামনা করেন। সিঁদুর খেলা ছাড়া দুর্গোৎসব অসম্পূর্ণ।

(৯) বিসর্জন: দশমী তিথিতে প্রথমে দেবীর ঘটে বিসর্জন হয়। শাস্ত্রমতে, এটিই আসলে বিসর্জন। এরপর মূর্তিতে কোনও প্রাণ থাকে না। ফলতঃ সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা সহকারে দেবীকে কোনও নদী বা নিকটবর্তী জলাশয়ে নিয়ে গিয়ে ভাসান দেওয়া হয়। কলকাতায় বিসর্জনের শোভাযাত্রা একটি দেখবার মত বিষয়। ধুনুচি নাচ এই বিসর্জনের-ও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শাস্ত্র মতে, বিসর্জনের প্রাক্কালে বুনো সিদ্ধির সরবত খেতে হয়। জলে দেবীকে ভাসান দেওয়া মাত্রই শুরু হয় বিজয়া।

(১০) বিজয়া: বিসর্জনের মাধ্যমে দুর্গাপুজো শেষ হলেও উৎসব মোটেই শেষ হয় না। দেবী দুর্গার বিসর্জন হয়ে যেতেই শুরু হয় বিজয়া। এ সময় একে অপরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হবে। এটিই বাঙালির রেওয়াজ। গুরুজনদের প্রণাম করা হয় আর সমবয়সী বা বন্ধুস্থানীয়দের সঙ্গে কোলাকুলি করা হয়। পুরাণ মতে, দশহরার দিন রাবণ বধ করে বিজয় উৎসব পালন করেছিলেন রাম-লক্ষ্মণ। মনে করা হয়, এই বিজয় উৎসব থেকেই বিজয়ার ধারণাটি এসেছে।