প্রতিবন্ধকতা হারিয়ে মনের জোরে আজ সফল আবৃত্তিকার দেবস্মিতা নাথ

0
416

খাস ডেস্ক: সিনেমার চিত্রনাট্যে আমরা বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের জীবনের লড়াইতে এগিয়ে যেতে দেখেছি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে বাস্তবে এই রকম অনেক স্পেশাল বাচ্চা আছে যারা নিজেদের মনের জোরে আর নিজেদের গুণ দিয়ে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিধাতা তাঁকে স্বাভাবিক বানাননি বলে যে অস্বাভাবিক বানিয়েছেন, তা ধরে নেওয়া ঠিক না। মাথায় কেবল এতটুক রাখা চাই যে শিশুটি কিছুটা বিশেষ প্রকৃতির, তার যত্নআত্তিও প্রয়োজন। আর বিশেষ গুণে সেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আজ এরকমই এক আবৃত্তিকারের কঠিন লড়াইয়ের কথা বলবো।

- Advertisement -

নাম দেবস্মিতা নাথ। ২০০১ সালে ১৬ এপ্রিল দুর্গাপুরে ছোট দেবস্মিতার জন্ম হয়। অন্য পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক ছিল না দেবস্মিতা তবুও অস্বাভাবিকও ছিলনা। ছমাস বয়সের মতো অন্যদের হামাগুড়ি দিতে শেখেনি দেবস্মিতা। এরপর দেবস্মিতার মা সুনিতা দেবী মেয়ের এই হামাগুড়ি দিতে না পারায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে জানতে পারলেন দেবস্মিতা অন্যদের থেকে একটু আলাদা।

তবে তিনি ভেঙে পড়েননি। চিকিৎসার জন্য ভেলোরেও নিয়ে যান। সেখানকার এক চিকিৎসক জানান, দেবস্মিতার এই সমস্যায় কোনো অপারেশন করানো যাবে না। বাড়িতে রেখে ফিজিওথেরাপি আর ওকে একটু বেশি সময় দিতে হবে। দেবস্মিতাকে গান, আবৃত্তি, কবিতা শোনানোর উপদেশ দিলেন।

ভেলোর থেকে ফিরেই কথামতো তাই করলেন সুনিতা দেবী। ধীরে ধীরে হাঁটা, তিন বছর বয়সে কথা বলা শুরু করে দেবস্মিতা। একসাথে বেশি কথা না বললেও ভেঙে ভেঙে কথা বলতো ছোট্ট দেবস্মিতা। তবে মেয়েকে মানুষ করাতে সুনীতা দেবী পাশে কাউকে পাননি।

নিজের স্বামীকেই পেয়েছেন। তবে সমাজের অনেক মানুষের কটু কথা, ইয়ার্কি শুনে পিছিয়ে যাননি। বরং নিজের সব ইচ্ছা বিসর্জন করে মেয়েকে মানুষ করেছেন। এরপর স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সুনীতা দেবী দেবস্মিতাকে গানে ভরতি করেন।

ছয় মাসের উপর হয়ে গেলেও গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়নি ছোট্ট দেবস্মিতার। তবে গান শুনতে ভালোবাসতো। এরপর স্কুল থেকেই নানান কবিতা শেখানো হত। সেগুলো শুনেই অদ্ভুতভাবে মুখস্থ হয়ে যেত দেবস্মিতার। সবার থেকে আলাদা করে প্রতিস্থাপন করত দেবস্মিতা।

একদিন এক কবিতার প্রতিযোগিতা দিতে অন্য স্কুলে পাঠানো হয়। প্রথম অন্য স্কুলে অন্যান্য বাচ্চাদের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। সেই বার ‘লিচু চোর’ কবিতা বলে দ্বিতীয় পুরস্কার নিয়ে আসে। এরপরই কবিতার প্রতি দেবস্মিতার বিশেষ ভালোবাসা জন্মায়। এরপরই বাড়িতেই দেবস্মিতার কবিতার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বিভিন্ন প্রতিযোগীতাতে অংশ নেওয়া শুরু করে আর প্রত্যেক অনুষ্ঠান থেকে আসত নানান পুরষ্কার।

তবে দেবস্মিতার জীবনে এগিয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারতনা তাঁর স্কুলের শিক্ষিকারা। এর জন্য নানান ভাবে অত্যাচার শুরু করা হয়। তবে সব বাধা পেরিয়ে নিজের কবিতাকে ধ্যানজ্ঞান করে এগিয়ে গিয়েছে দেবস্মিতা। তবে সব বাধা পেরিয়ে ধীরে ধীরে লোকাল টিভি চ্যানেল, পুজোর সময় স্থানীয় জায়গায় নানান অনুষ্ঠান করা শুরু করে দেবস্মিতা।

মাত্র ১৩ বছর বয়সে দুর্গাপুরে ব্রততী বন্ধোপাধ্যায়ের কাছে ওয়ার্কশপ করার সুযোগ পায় ছোট্ট দেবস্মিতা। বড় হতে পড়াশোনার সঙ্গে কলকাতায় মায়ের সঙ্গে এসে কলকাতায় সুজাতা সদনে অনুষ্ঠান শুরু করে দেবস্মিতা। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

রবীন্দ্র সদন ,বিড়লা একাডেমী ,শিশির মঞ্চ , ত্রিগুনাসেন মঞ্চ , রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন , বাংলা অ্যাকাডেমি একাধিক জায়গায় শুরু হয় অনুষ্ঠান। যখন দেবস্মিতার ১৮ বছর বয়স তখন প্রথম সিডি লঞ্চ হয়। সিডির নাম ‘তোমায় প্রণমি’। এটি মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা পাঠ।

এই বয়সে পঞ্চম বর্ষ বঙ্গ প্রমীলা কৃতী রত্ন সম্মানে সম্মানিত হয় দেবস্মিতা। এখন দেবস্মিতা বাচিক শিল্পী হিসেবে বেশ খ্যাত। কবিতা পাঠনের সাথে ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছে। পাশাপাশি আবৃত্তিকে নেশার পাশাপাশি পেশা হিসেবেও বেছে নিয়েছে। দেবস্মিতা এখন কিছু বাচ্চাকে আবৃত্তি শেখায়।

দেবস্মিতার জীবনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তাঁর মা। বেস্ট ফ্রেন্ড বললেও কম। মাকে কোন কবিতা বলবে না বলবে কিভাবে সবই মাকে শোনাবে। আর সুনীতা দেবীও দেবস্মিতার আবৃত্তি শোনার সেরা শ্রোতা। করোনা আবহে আবৃত্তি করা থেমে থাকেনি।

ভার্চুয়ালী নানান অনুষ্ঠান করছে দেবস্মিতা। এই রবীন্দ্র জয়ন্তীতে স্বরশ্রুতি কালচারাল অ্যাকাডেমির কবিপ্রণাম ও কলাকুশলীর লাইভ অনুষ্ঠানের সঙ্গে রবিমাস ও প্রচুর ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান করেছে। খাসখবর থেকে দেবস্মিতাকে অনেক অনেক শুভচ্ছা। এইভাবে নিজের আবৃত্তি নিয়ে এগিয়ে যাক জীবনে।