মিষ্ট ভাষণ যখন জালিয়াতির প্রথম লক্ষণ

0
69

সুজয় গুহ: জালিয়াতি সর্বত্র। যদি এই দুটি শব্দের প্রয়োগ এখানে পাঠকের মাত্রাতিরিক্ত বলে মনে হয় তাহলে বাকি রচনার শব্দ ব্রহ্মে না চোখ চালানোই শ্রেয়। কারণ, অনুমান থেকে এই সিদ্ধান্তে আসতে বেশ সময় নিয়েছেন চালাক শহরের বোকা নাগরিক মণিদা।

আরও পড়ুন: তুমি বন্ধু কালা পাখি, আমি যেনো কি

- Advertisement -

মধুর মিষ্টি কথা

আধা দৌড়ানো আধা লাফানো ভঙ্গিতে এক হাতে বালতি অন্য হাতে দেবদারু গাছের ডাল নিয়ে মাছি তাড়ানোর বিকৃত শারীরিক কসরতে মণিদার সামনে এসে থামল পাঁচ ফুট উচ্চতার শ্যামলা লোকটা। বালতিটা সশব্দে রেখে, নেচে কেঁদে বোঝানোর চেষ্টা করলো সর্ব শরীরের মৌমাছির দংশন। বাড়ির সামনে অসহায় গরীব মানুষটার এহেন দুর্দশা দেখে আসুরিক শক্তির অধিকারী মণিদার মন বিচলিত হয়ে উঠল। মুহূর্ত পূর্ব আগেই তেতে ওঠা রোদে দগ্ধ শ্যামলা বলে ভ্রম হওয়া নিকষ কালো লোকটার প্রতি সহানভূতিপ্রবণ হয়ে মণিদার কিছু একটা করার উদ্যোগ নেওয়ার চঞ্চলতা দেখে লোকটি হঠাৎই শান্ত হয়ে তার পরিস্থিতি যে ততটা উদ্বেগজনক নয় বরং এটি যে একান্তই নিত্য নৈমিত্তিক একটি ঘটনা তা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল। মধুতে পরিপূর্ণ বালতির মধ্যে একটি মৌচাক সহ হাতে গোণা কয়েকটি মৌমাছির দেহাবশেষও প্রত্যক্ষ করা গেল। লোকটি যে নিয়মিত মৌচাক ভেঙে সংগ্রহ করা টাটকা মধু স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিকের শারীরিক উন্নতির জন্য একেবারেই কম দামে সরবরাহ করে তা মণিদাকে আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করল। ভ্রূকুঞ্চিত ক্রেতার সন্দেহ দূর করতে বিক্রেতা নিজেই পকেট থেকে একটি দশ টাকার নোট মধু পূর্ণ বালতিতে নিমজ্জিত করে তুলে নিয়ে তাতে ফশ করে অগ্নি সংযোগ করে মধুর স্বচ্ছতা প্রমাণে যারপরনাই চেষ্টা করতে লাগলেন। আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে টাকার উপরিতলের মধু টগবগ করে ফুটতে শুরু করলে খাঁটি এবং বিশুদ্ধ মানের পরীক্ষায় লেটার মার্কস সহ পাশের আশায় বিক্রেতার কালো মুখমণ্ডলের মধ্য থেকে ততোধিক শুভ্র দেতো হাসি বেরিয়ে এলো। অক্ষত দশ টাকা বিক্রেতা ফের পকেটে চালান করলেন। দর কষাকষি শেষে মাত্র তিনশো টাকায় মধুরেন সমাপয়তে, জয়ীর হাসি দুপক্ষেই।

গরম জলে পাতিলেবুর রস, মধু। গিন্নির মেদ ঝরানোর উত্তম দাওয়াই দিয়েছিল যদু মিত্র। শর্ত ছিল খাঁটি মধু চাই। গত তিন মাসে গিন্নির ওজন তিন কেজি বেড়েছে বই কমেনি। চিন্তিত মণিদা সেদিনের মধু কেনার অভিজ্ঞতার কথা অভিজ্ঞমহলে পেশ করে বুঝতে পারলেন, বিক্রেতার মধুর মিষ্টি কথা এবং পরীক্ষালব্ধ ভুল ফলের কারণেই খাঁটি মধু চিনতে অকৃতকার্য হয়েছেন। আগুনের সংস্পর্শে আসলে বিশুদ্ধ মধুর জ্বলে যাওয়ার কথা ছিল, টগবগ করে ফোটার কথা নয়।

পাখার মিষ্টি হাওয়া

আবহাওয়া না যতটা গরম সবজি বাজারের তাপ তার থেকেও বেশি। চালের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই দরদর করে ঘাম ছুটল মণিদার শরীর বেয়ে। চালের দোকানী বিনা পাখায় নির্বিকার বসে। মণি দা স্মিত হেসে পাখাটা চালানোর অনুরোধ পাড়লেন। দোকানী নির্লিপ্তভাবে মণিদাকে অভিভাবকের সুরে আগে একটু জিরোনোর নিদান দিলেন। ঘর্মাক্ত কলেবরে বৈদ্যুতিন পাখার হাওয়া শরীরে রাসায়নিক অনুপাতের কি কি হেরফের করাতে পারে তার অতীত উদাহরণ স্বরূপ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেন। এরপর কত কেজি চাল লাগবে তার হিসাব নিলেন। পেল্লায় ডিজিটাল পাল্লায় বসানো চাল মাপার বিরাট ফাঁকা টিনের পাত্রর ওজন শূন্যতে আনার জন্য একাধিক বোতাম টিপলেন। এরপর মণিদার দিকে বহুদিনের চেনা সম্পর্কের মতো হাসি দিয়ে তিনি যে কতোটা সৎ ব্যবসায়ী তার প্রমাণ রেখে অন্য একটি পাত্র দিয়ে একহাতে টিনের পাত্রে চাল ঢালতে ঢালতে অন্য হাত দিয়ে পাখার সুইচটা অন করে বললেন একটু কষ্ট দিলাম এবার মিষ্টি হাওয়ায় শরীরটা জুরিয়ে নিন। ভদ্র দোকানির মিষ্টি ভাষণ ও ততোধিক অমায়িক ব্যবহার তৎসহ ডিজিটাল পাল্লার ঠিক উপরেই অত্যধিক গতির পাখার ঠাণ্ডা হাওয়ায় মণিদার দৈহিক ক্লান্তির অনেকটাই লাঘব হল।ডিজিটাল কাঁটায় কুড়ি কেজি চালের মাপে এক গ্রামও বেশি না পাওয়ার খানিকটা বেদনা চেপে মণিদা বাড়ির পথে পা বাড়ালেন।

গিন্নির আবদারে ছুটির দিনের বিকালটাও রেহাই পেলেন না মণিমাধব সান্যাল। গন্তব্য স্যাকরার দোকান, হেতু শ্যালকের বিয়ের নূন্যতম উপহার।একটু হেঁটে সোনার দোকানে পৌঁছাতেই ঘেমে নেয়ে একসার অবস্থার জন্য নিজের শরীর না আবহাওয়া কোনটি দায়ী সেটা চিন্তা করছিলেন মণিদা। গিন্নির এটা না ওটা না সেটার চক্করে শরীরটা খারাপই লাগছিল বোধ হয়, এমন সময় দোকানী দিল পাখাটা বন্ধ করে। বিশালদেহির অগ্নিশর্মা মণিদা দোকানির এহেন অভিপ্রায়ের কারণ জেনে তো আকাশ থেকে পড়লেন। এক পাখার হওয়ার চক্করে সোনার ওজন ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম বেড়ে যেতে পারে শুনে আঁতকে উঠলেন। যদিও দোকানী আশ্বস্ত করলেন কাচের বক্সে রাখা ডিজিটাল পাল্লা অনেক বিশ্বস্ত, তবুও যেটুকু ফাঁক তাতেও খরিদ্দারের অর্থের অপচয় রুখতে তিনি যে কতোটা বদ্ধপরিকর তার লম্বা ফিরিস্তিও দিলেন। যদিও পাখার মিষ্টি হওয়ার চক্করে মণিদা কোথায় কোথায় কতো দিন যাবৎ কতো গ্রাম নিত্য সামগ্রী ক্রয় করতে প্রতারণার শিকার হয়েছেন তাতে মনোনিবেশ করায় দোকানীর অমৃত বাণী কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। উল্টে গিন্নিকে সোনার গহনায় হলমার্ক, ক্যারেট, দোকানির মার্ক আছে কিনা যাচাই করার আদেশ দিয়ে জামার হাতা গুটিয়ে বড় বড় চোখ করে কোনও কিছু বেচাল ঘটছে কিনা সে বিষয়ে একটু বেশিই সতর্কতা দেখিয়ে কেনাকাটা শেষ করলেন।

খাস খবর ফেসবুক পেজের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/khaskhobor2020/

গৃহ প্রবেশের মিষ্টি

ছেলের বিয়ের অনেক আগে থেকেই নতুন একটি ফ্ল্যাটের খোঁজ চালাচ্ছিলেন মণিদা। প্রয়োজনটা আগে বুঝলেও নিজের ব্যাংক ব্যালেন্সের দিকে তাকিয়ে বার বার পিছিয়ে এসেছেন তিনি। হঠাৎই ছেলে নিজেকে বিয়ের উপযুক্ত পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একের অধিক প্রচেষ্টা চালানোয় আচম্বিতাশ্চর্য মণিদা নতুন ফ্ল্যাট কেনার ব্যাপারে অন্তরের তাগিদ অনুভব করলেন। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে ট্রেনের কামরায় সাটা লিফলেটের যোগাযোগ নম্বর পকেট বুকে লিপিবদ্ধ করে ফোনালাপ শুরু করলেন। বার তিন চারেক এদিক ওদিক দৌড়ে দু’চারটি ফ্ল্যাট দেখলেও বাস্তু ও দিক নির্ণয়ে ডেভেলপারের যে খামতি রয়েছে তা বিলক্ষণ বুঝলেন মণিমাধব সান্যাল। মনের মতো ফ্ল্যাট না পেয়ে তিনি যে মনোকষ্টে ভুগছেন তা ঘনিষ্ট মহলে ব্যক্ত করলেন। অসহিষ্ণু হয়ে বাড়িতে ছেলে বউয়ের প্রতি অকারণে চেঁচামেচি করলেন। অফিস ছুটি নিয়ে নিজেকে ঘরবন্দী করলেন। যতদিন ফ্ল্যাট না কিনতে পারছেন ততদিন অন্ন স্পর্শ করবেন না বলেও নাকি তিনি জানিয়েছিলেন। ঠিক এমন ঘোর দুর্দিনে সদ্য বিবাহিত শালা মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে জামাইবাবুর পাশে এসে দাঁড়াল। শ্বশুরের ছত্রতলে ভোম্বল মার্কা শরীরে বেড়ে ওঠা শালার বিবাহ পরবর্তী পরিবর্তনে হতচকিত এবং চমৎকৃত জামাইবাবু প্রমাণ সাইজের মিষ্টির হাঁড়ির কার্য কারণ জানতে চাইলেন। তার এক বন্ধু কাম প্রোমোটারই যে অনতিদূরেই লেকের ধারের আবাসনের নির্মাতা, আর এই মিষ্টি যে মেঘ না চাইতেই জলের মতো আগাম গৃহ প্রবেশের মিষ্টি তা বুঝিয়ে জামাইবাবুর অ-উল্লিখিত অনশন ভেঙে দিদির মুখের পুরনো হাসি ফিরিয়ে আনলো তার একমাত্র শালা। শীঘ্রই মণিমাধব সান্যাল শালার দুচাকার বাহনে উপবিষ্ট হয়ে লেকের ধারের আবাসনের যে কয়টি ফ্ল্যাট অবিক্রিত ছিল তার প্রতিটি ইঞ্চি চষে ফেললেন। বাস্তুর প্রতিটি শাস্ত্র বাক্য অক্ষরের অক্ষরে মিলিয়ে মনের মতো ফ্ল্যাটটি নির্দিষ্ট করলেন। পূর্ব দিকে বিস্তৃত ব্যালকনি, দক্ষিণ পশ্চিমে সিড়ি ও ঠাকুর ঘর সহ প্রায় ন’শো বর্গ ফুট আয়তনের ফ্ল্যাট সাত তাড়াতাড়ি হস্তান্তর হল তিথি নক্ষত্র মিলিয়ে। টপ ফ্লোর হওয়াতে দামে ছাড়ও মিলল বিস্তর।

আসল গৃহ প্রবেশের আগের রাতে অবশ্য প্রকৃতি বিরূপ ছিল। সে কি বিরামহীন ঝর জল বৃষ্টি! মণিদার মনে কু’ডাকলেও তিনি তাতে তেমন আমল দেননি। নিজ ফ্ল্যাট হতে পুত্রের ফ্ল্যাট অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যেই। ভোর থাকতে থাকতেই উঠে পড়ে গিন্নি, পুত্রকে জাগিয়ে তুলে সাত সকালেই পৌঁছে গেলেন পুজোর সামগ্রী, কুল পুরোহিত সমেত। আবাসনের নিচে লোক সমাগম দেখে কুঞ্চিত ভ্রু যুগল ফের স্বাভাবিক করে পুত্রের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুধালেন প্রতিবেশী ফ্ল্যাটে নিমন্ত্রিতের সংখ্যা একটু বেশি হয়ে গিয়েছে কিনা। নিকটে এসে ভুল ভাঙল মণিদার, এ সমাগম তার পুত্রের নতুন ফ্ল্যাটের নিমন্ত্রিতের নয়। সিকিউরিটির সঙ্গে বাক ও বিতন্ডা দুইই এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে সঙ্গে উত্তম মধ্যম দেওয়ার স্বরও চড়ছে। একজন নির্জীব গোছের চেনা প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসার জবাব পেয়ে আবাসনের ভিতরে দৌড়ালেন। পর পর সিড়ি ভেঙে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে ক্রমশ তার পেশী শক্তি কমে আসতে লাগলো, বুঝিবা চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলেন নতুবা এসব ভ্রম মনে হল। নতুন আবাসনের দেওয়াল, উপরিতলের দেওয়াল হতে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু জল তখনও টপ টপ করে পড়ছিল কমন স্পেসে। কাঁপতে কাঁপতে পকেট থেকে চাবি বার করে পুত্রের নতুন ফ্ল্যাটের দরজা খুলে চোখ কচলে দেখলেন যোধপুরের ফার্নিশড মার্বেলের উপর অন্তত আধা ইঞ্চি জলের আস্তরণ, দেওয়াল ও ছাঁদের সূক্ষ চির হতে আগত জলবিন্দু ঘরের টেক্সচার কালারকে অ্যাবসট্র্যাক্ট আর্টে রূপান্তর ঘটিয়েছে। মণিদার বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। যখন জ্ঞান ফিরল তখন তিনি সরকারি হাসপাতালের সজ্জায়, পাশে সজল নয়না গৃহিণী। মণিদা গিন্নির হাতটা ধরে করিৎকর্মা শালার মুখটা শেষ বারের জন্য দেখতে চাইলেন।