আজ মনে পড়ছে তো কার্গিল যুদ্ধের নায়ক শহিদ কনাদ ভট্টাচার্যকে

0
584

সংকর্ষণ ঘোষ: বিজয় দিবসে বাঙালিকে কোনোকালেই খুব কিছু উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়না, দুয়েকজন যাঁরা হন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা সেদিনের যুদ্ধ সম্পর্কে জানেননা একটি বর্ণও। আসলে কূটবুদ্ধিতে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহের পাশাপাশি সম্মুখসমরে বাঙালির অনীহা সম্পর্কে অন্যদের মতোই অবগত বাঙালি নিজেও, তাই হয়তো খোঁজ রাখবার প্রয়োজনবোধ আমরা ক’রিনি সেভাবে।

আরও পড়ুন- মাথার খুলির ঠিকানা পেটে, প্রাণ বাঁচাতে ‘বিরল’ অস্ত্রোপচার কলকাতায়

- Advertisement -

সৈন্যবাহিনীও নির্বিবাদে আমাদের জন্য কেবল বলিদান দিয়েই এসেছেন, তাঁদের হয়ে কিছু বলবার জন্য কখনও আমরা এগোইনি, শাসক এগোননি, বিরোধী এগোননি, এমনকি ব্যক্তিগত স্বার্থেও তাঁদের ওই ব্যবহারই করেছে মৌলবাদীরাও। যে রাজনৈতিক দলকে আমরা বাংলায় শুধু বাঙালিরই রাজত্ব বলতে শুনেছি অধিনায়ক ভট্টাচার্যকে চেনেনা তারা। তাঁকে চেনেনা ভাষার নামে অপরাজনীতির ধ্বজাধারী ‘বাংলাপক্ষ’, তাঁকে চেনেননা কোনো সরকারী বা বেসরকারী শিল্পী কিম্বা বুদ্ধিজীবী।

তাঁরই সমগোত্রীয় অধিনায়ক আরেকজন শহীদ বিক্রম বাত্রার জীবনের ওপর একাধিক চলচ্চিত্র তৈরী হ’য়ে যায়, যুদ্ধজয়ের ওপর বিক্রী হয় অসংখ্য বই (পরাজিত এক বাঙালির স্থানসঙ্কুলান আর হয়না সেখানে)। সেই বিস্মৃত নায়ক আজও প্রাপ্য সম্মানের অপেক্ষায় আছেন কিনা আমরা জানিনা, তাঁরা তো কিছুর আশায় ভালোবাসেননি এই দেশকে। শুধু এটুকুই সত্য র’য়ে যায় যে তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। স্বজাতি হ’য়ে যারা তাঁকে ভুলেছে তারা তো অপরাধীই, কিন্তু কণাদরা এই বাংলাতে ঠিকই জন্ম নেন। বারবার তাঁরা ফিরে আসেন বাঙালি বীরত্বের প্রতিচ্ছবি হ’য়ে। সেই বাঘাযতীন, নেতাজী প্রমুখদের চাক্ষুষ করাতে তাঁরা ফিরে আসেন। আসবেনও।

১৯৯৯-এর মার্চ মাসের২১তারিখ যখন পাহাড়ের চূড়া থেকে অকস্মাৎ স্নাইপার (লক্ষ্যভেদী বন্দুক) এবং স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু হয় তখন পরিস্থিতির কিছুই তাদের পক্ষে ছিলনা। সংখ্যায় সামান্য কিছু সৈন্য, যুদ্ধনীতি অনুসারে আত্মরক্ষার জন্য ওজনে হালকা কিছু অস্ত্র, প্রবল শীতার্ত পরিবেশ এবং অবস্থানগতভাবে নিম্নাঞ্চলে তারা একরকম অসহায়ভাবেই প্রাণ বিসর্জন ক’রছিলো।

কিন্তু আশ্চর্যভাবে খানিকক্ষণ পরেই শত্রুপক্ষ দেখতে পায় যে অষ্টম শিখ বাহিনী দু’টি পৃথক অংশে ভাগ হ’য়ে গিয়ে পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠতে উঠতে পাল্টা আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ ক’রছে এবং সম্মুখসমর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকায় এরা সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হ’য়ে যায়। কিন্তু এতো কৌশল ক’রেও শেষরক্ষা হয়নি, যেহেতু অবস্থান ভারতবর্ষের বিপক্ষে ছিলো। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার ক’রে কিছুক্ষণের জন্য সন্ত্রাসবাদীরা পশ্চাদপসারণ ক’রতে বাধ্য হয় ঠিকই, কিন্তু অষ্টম শিখ বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে সম্পূর্ণভাবে নিখোঁজ হ’য়ে যায়। হয়তো সেদিন যোদ্ধারা কেউই বাঁচতে পারেননি।

কিন্তু শত্রুকে বিভ্রান্ত ক’রে দিতে সেদিন যে দক্ষতা ভারতীয় সৈন্যবাহিনী দেখিয়েছিলো তার নেপথ্যে ছিলেন ২জন। ‘সেপাই মেজর সিংহ’কে নিজের সহকারী হিসাবে রেখে সম্পূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা ক’রেছিলেন ২২বছর বয়সী এক বাঙালি। কলকাতার টালা অঞ্চলে বেড়ে ওঠা শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের ছাত্র এই তরুণের স্বপ্ন ছিলো ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ করা, যা তিনি পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘ওটিএ’ বা অফিসার্স ট্রেনিং অ্যাকাডেমি থেকে পাশ ক’রে পূরণ করেন। এর পাশাপাশি ক্রিকেট ও ক্যারাটেতেও এনার দক্ষতা ছিলো সহজাত। যুদ্ধক্ষেত্রে অজস্র আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও ইনি ও এনার পরিচালিত অংশ শেষ মুহূর্ত অবধি এতো বেশী ক্ষিপ্রতা দেখিয়েছিলেন যে শত্রুপক্ষ বুঝতেই পারেনি বিপক্ষের অবস্থান আসলে কী?

এরপর প্রায় পৌনে দু’মাস যাবৎ টাইগার হিল শত্রুপক্ষের অধিকারে থাকবার পর ১৫জুলাই তাঁর মরদেহ উদ্ধার হয়। যুদ্ধশেষে মরণোত্তর ‘সেনা পদক’ (সেনা মেডেল) লাভ করেন তিনি। বলা হয়, পরাজয়ের কালেও ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর লেফটেন্যান্ট হিসাবে তিনি যে বীরত্বের উদাহরণ দেখিয়েছেন তা’ই পরবর্তীকালে এই যুদ্ধজয়ের অন্যতম স্তম্ভ হ’য়ে দাঁড়ায়। আজও তাঁর অন্যতম পরিচয় ‘সার্ভিস নম্বর- এস এস তিন সাত আট এক আট’। সেই ঘটনার একুশ বছর পরেও অপারেশন বিজয়ের (কার্গিল যুদ্ধের) প্রথম বাঙালি শহীদ অধিনায়ক কণাদ ভট্টাচার্য আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন টালা সেতুর ওপরের বাস দাঁড়াবার স্থানে কেবল একটি ছবি হ’য়ে। সেদিনের সেই ২২বছর বয়সী উজ্জ্বল তরুণ, যাঁর হাত ধ’রে ক্ষণিকের জন্য হ’লেও সমগ্র বাঙালি জাতির নাম থেকে অদৃশ্য হ’য়েছিলো ‘ভেতো’ উপাধি। স্বজাতি হিসাবে আমরা ভুলে গেলেও তাঁর জন্মভূমি ও প্রাণপ্রিয় সৈন্যবাহিনী তাঁকে ভোলেনি। এখনও বিজয় দিবসে তাঁর নাম সেসব স্থানে ভেসে বেড়ায়, এখনও গর্ব পরিস্ফূট হ’য়ে ওঠে অষ্টম শিখ রেজিমেন্টের কথা ব’লতে গেলে।

জয়হিন্দ।