রবীন্দ্রনাথ ও প্ল্যানচেট

0
900

বৈশালী চট্টোপাধ্যায়: হেমন্তের নিস্তব্ধ এক সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের উদয়ন বাড়ির এক ঘরে জ্যোতি দাদাকে জানাচ্ছেন রবিঠাকুর- ‘সেদিন আপনার কথা শুনে খুব উপকার হয়েছে। মন শান্ত করতে পেরেছি’। চলছে ছোট ভাই রবির সঙ্গে আলাপ আলোচনা। একযোগে মনের টানেই বোধ হয় এদিন আকাশ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অশরীরী আত্মা নেমে এসেছিল ওই ঘরে।

কিছুটা অবাক লাগলেও, রবিঠাকুরের কবি বা দার্শনিক রূপের বাইরেও নানান রূপ বর্তমান ছিল। মৃত্যু মানুষকে মুছে দেয়, তবু রবিঠাকুর পরলোকের সঙ্গে যোগের কথা কখনওই উড়িয়ে দেননি। অথচ তাকে ‘ধর্মবিশ্বাস’-এর সঙ্গেও জড়িয়ে ফেলেননি তিনি। এমনই কিছু দৃষ্টান্তও বেশ কিছু লেখায় উঠে আসে।

- Advertisement -

শয়নকক্ষের মেঝেতে গোল হয়ে বসে উমা ও রবিঠাকুর। আত্মাকে প্ল্যানচেট করে এই ভূমিতে আনতে গেলে দরকার মিডিয়াম। আর সেই মিডিয়ামই হলেন রবিঠাকুরের বন্ধু ‘কাব্যগ্রন্থাবলী’-র সম্পাদক মোহিতচন্দ্র সেনের কন্যা উমা। প্রশ্ন করতেন রবিঠাকুর আর উত্তর দিতেন উমা থুরি পরলোক থেকে আসা অশরীরী। আসরে দর্শকের তালিকায় থাকতেন অবনীন্দ্রনাথ থেকে নন্দলাল বসু, মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, মীরা দেবী এবং আরও অনেকে। কখনও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আবার কখনও শান্তিনিকেতনেই প্রেতযোগ স্থাপন করতেন রবীন্দ্রনাথ।

শ্রী প্রথমনাথ বিশী রবীন্দ্রনাথের কাছে জানতে চেয়েছিলেন মাইকেল সম্পর্কে কোনও স্মৃতি তাঁর মনে আছে কিনা। এ প্রসঙ্গে রবিঠাকুরের লেখা এক চিঠিতেই প্ল্যানচেটের সঙ্গে তাঁর ছোটবেলা থেকেই যোগ যে বর্তমান তা বেশ বোঝা গিয়েছে। চিঠিতে তিনি লেখেন- “আমাদের বাড়িতে মাইকেলের গতিবিধির পরে আমার জন্ম। আমি তাঁকে দেখিনি। একবার প্রেতবাণীবহ চক্রযানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটা সাক্ষ্যরূপে আদালতে গ্রাহ্য হবে না। ইতি, ২১ শ্রাবণ ১৩৪৪”। অর্থাৎ এর থেকে খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে বাল্যকালেই তিনি ‘প্রেতবাণীবহ চক্রযানে’ মাইকেলকে ধরায় নামিয়ে এনেছিলেন।

১৩৫২ সালের বৈশাখ আষাঢ় মাসে প্রকাশিত বিশ্বভারতী পত্রিকায় উর্মিলা দেবীর একটি রচনায় রবিঠাকুর ও তাঁর মেজদিদি অমলা দাসের একটি কথোপকথনের উল্লেখে আছে। রবিঠাকুর যেখানে মেজদিদিকে মৃণালিনী দেবী সম্পর্কে বলেছেন, “মানুষ মরে গেলেই যে একেবারে হারিয়ে যায়, জীবিত প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেকথা আমি বিশ্বাস করি না”। বলা হয়, মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পরে বহুবার তাঁকে প্ল্যানচেট করে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

প্রিয় নতুন বৌঠানকেও যে কয়েকবার তিনি এনেছিলেন তার উল্লেখও বেশ কিছু জায়গায় পাওয়া যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এই যে, রবিঠাকুরের জীবনের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ এই দুই মহিলার সঙ্গে প্ল্যানচেটের উল্লেখ থাকলেও কথোপকথনের লিপিবদ্ধ রূপ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে অমিতাভ চৌধুরীর লেখা ‘একত্রে রবীন্দ্রনাথ’-এ উল্লেখ আছে এমন অনেক বিস্তৃত প্রেতযোগের। সেখানে রবীন্দ্রনাথের আটটি ভৌতিক খাতার সন্ধান লেখক পেয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে।

রবীন্দ্রসাহিত্যের মতোই অনেক রোদ ছায়ায় ভরা তার জীবন। তাঁর রূপ কখনও ফুটে উঠেছে অন্বেষক হিসেবে, কখন বা কবি-দার্শনিক রবিঠাকুর হিসেবে ধরা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু জানার বাইরেও কিছু অজানা থাকে। এর বাইরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনও বিদেশিনীর অনুরাগী, কখনও আবার আলু কিংবা আখ চাষের আগ্রহী। এর মধ্যেই কবিগুরু যে পরলোকেও আগ্রহী তাঁর রূপও ধরা পড়েছে। তাই অনন্য রবি মহিমার অন্যতম এক রূপ এই পঁচিশে বৈশাখে কবির স্মরণে উৎসর্গীকৃত হল।