বঙ্গজ শিল্পীদের একে একে মহাপ্রয়াণ কি কোন নতুনের সঙ্কেত আগামী রেনেসাঁর  

0
50

সুকুমার দেবনাথ: এই পথ যদি না শেষ হয় কেমন হত বলতো! উত্তম -সুচিত্রার লিপে হেমন্ত-সন্ধ্যার সেই যুগান্তকারী গান আজ সর্বত্র ক্যাসেটে টিভিতে গানের অনুষ্ঠানে বেজেই চলেছে। বেজে চলেছে-

‘এই কি গো শেষ দান

- Advertisement -

মোর আরও কথা

আরও কথা ছিল বাকি

আরও প্রেম আরও গান।’

আমাদের প্রিয় তিন গায়ক আমাদের হৃদয় শূন্য করে শূন্যে মিলিয়ে গেলেন। এই শূন্যতা সহজে পূর্ণ হবার নয়। লতা মুঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বাপি লাহিড়ী। শেষের দুজন বাংলার প্রাণের মানুষ। সুরের আকাশের ধ্রুব তারা। সুর নক্ষত্র।

উনবিংশ শতাব্দীতে একটা রেঁনেসাঁ এসেছিল বাংলায়। কত কবি কত গায়ক নায়ক যুগান্তকারী সব সৃষ্টি করে গেছেন। কত রাজনীতিক, সাংষ্কৃতিক, সমাজ সংষ্কারকের আগমন ঘটেছিল সেই সময়। কত শিল্পকলার আদান প্রদান ঘটেছিল। রামমোহন, ডিরোজিও থেকে কেশব সেন, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, বেগম সাখাওয়াত, বেগম রোকেয়া, দীনবন্ধু  মিত্র থেকে মাইকেল মুধুসুদন দত্ত। রবীন্দ্রনাথ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ কে ছিলেন না সেই তালিকায় ! রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী থেকে শরৎচন্দ্র, রাজনীতিক সাংষ্কৃতিক দিকপালেরা মিলে বাংলার সেই স্বর্ণযুগ এনেছিলেন। এদের উত্থান যেমন এক শতক ধরে ঘটেছিল তেমনি অস্তমিত হতে সময় লেগেছিল এক’শ বছর। উনিশ শতকের সেরা ঘটনা বাংলার সেই রেনেসাঁ।

প্রথম রেনেসাঁ ঘটেছিল ইটালি, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশে। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত তা চলেছিল। সে যুগে শিল্প সংষ্কৃতির ক্ষেত্রে এমন কিছু মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল যা পৃথিবীকে অনেক কিছু  দিয়ে গেছে। রেনেসাঁ দিয়েছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চ, ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসো, পিয়েরো দেলা ফ্রান্সিসকা, স্যন্ড্রো বত্তিবেল্লির মত যুগান্তকারী শিল্পীদের। ভারতের তথা বাংলার রেনেসাঁ এরপরে এসেছিল উনবিংশ শতাব্দীতে। আমরা পেয়েছি উইলিয়ম কেরি, ডিরোজিও, রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, কেশব সেন থেকে গিরিন সেন বিবেকানন্দর মত দিকপাল পন্ডিতদের যারা শিক্ষা সংষ্কৃতি সমাজ সবকিছুতে অগ্রগতির ছাপ রেখে গিয়েছেন।

 সে ছিল এক স্বর্ণযুগ। সেই যুগের পতন ঘটল। রেনেসাঁ উত্তর যুগেও এসেছেন বহু মহাপ্রাণ। আমরা দেখলাম অনুশীলন সমিতির নেতাদের। জীবন বাজী দেশের জন্য। তাদের অনেকেই  পরপর মারা গেলেন। ১৯৯৭ এর ডিসেম্বর মারা গেলেন গোয়া আন্দোলনের পথিকৃত বহরমপুরের সাংসদ ত্রিদিব চৌধুরী যার নাম নিয়ে চাষীরা চাষ শুরু  করতেন ক্ষেতে। সেই সময় প্রতুল চৌধুরী, মণিচক্রবর্তী, ভবানি ভট্টাচার্য্য  প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামী,অনুশীলন সমিতির সংগঠকরা মারা গেলেন। পরপর দশ বারোজন নেতার মৃত্যু  ঘটেছিল, যা এক বিস্ময়কর ঘটনা। তেমনি একটি যুগের অন্তিম সুর শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পর বাপী লাহিড়ী আমাদের শূন্য করে শূন্যে মিলিয়ে গেলেন। দেবদাস, আতঙ্ক’র মাষ্টারমশাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের আতঙ্কিত করে আগেই চলে গেছেন। এরা চলে যাওয়া মানে একটি যুগের পতন। এখন পরিবর্তনের যুগ। এরা ধরে রেখেছিলেন পরিবর্তনপূর্ব যুগের ধারাকে। সেই যুগের পরিচিতি বহন করতেন এরা। ‘পহেচান’ ‘আইডেন্টিটি’ও এরা। তাঁরা একে একে চলে গেলেন। তাই এক যুগের শূন্যতায় ভুগতে চলেছি আমরা।

এস ডি বর্মন, আর ডি বর্মনের মত অনেকেই বাপি লাহিড়ীর আগেই মুম্বাইগামী হয়েছিলেন। তবুও এরা কেউ বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। এই যুগের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র, মুম্বাইয়ে আধিপত্য নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো এক প্রাণপুরুষকে হারাল বাংলা। সন্ধ্যাদির মত এক নিষ্কলুষ মহাপ্রাণকে আর বাংলার জন্য গাইতে শুনব না। যার কন্ঠ শেষদিন পযর্ন্ত ছিল সুরেলা। মুখ্যমন্ত্রীকে গান শুনিয়েছিলেন বঙ্গবিভূষণ পুরষ্কার গ্রহণের সময়ে।

বাপি লাহিড়ী মুম্বইয়ে গিয়ে বাপ্পী লাহিড়ী হয়ে গিয়েছিলেন। বাঙ্গালী বাপীকে হিন্দিভাষীরা আপন করে নিয়েছিলেন। বাঙালির প্রাণের বাপীদা এই রাজ্য থেকে বিজেপির হয়ে লোকসভায় দাঁড়িয়ে নির্বাচন লড়েছিলেন। যেতেননি ঠিকই কিন্তু বেশ আলোড়ন তুলেছিলেন। সাময়িকভাবে বাপীদা আধা হয়ে গিয়েছিলেন। ভোট শেষ হতেই আবার পূর্ণ বাপীদা। এখানেই মজা সাংষ্কৃতিক জগতের লোকদের নিয়ে। তারা আবেগপূর্ণ হন তাই অনেকেই তাদের আবেগকে ক্যাশ করে নানা কিছু  করিয়ে নেন। তবে শিল্পীর শিল্প ভাগ হয়না, যেমন বাংলা ভাগ হলেও ভাগ হননি কবি নজরুল।

অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯৪৯-এ লিখেছিলেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল। আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নিকো নজরুল’,। রবীন্দ্রনাথও ভাগ হননি। তার লেখা জাতীয় সঙ্গীত দুই বাংলাতে গীত হয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ‘পদ্মশ্রী’ জাতীয় খেতাব নিতে অস্বীকার করার পেছনে অনেকেই রাজনীতি দেখেছেন। শিল্পী রাজনীতির স্বীকার বলে অভিযোগ করেছেন গেরুয়া শিবির। তবে নবতিপর (৯০) বিদগ্ধ শিল্পীকে ‘পদ্মশ্রী’র বদলে ‘পদ্মবিভূষণ’ দেওয়া উচিৎ ছিল। সেদিক থেকে বিচারকদের জ্ঞান ও গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বাংলার থেকে বাঙালিদের থেকে বিশদে জেনে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল যা হয়নি।।

রেনেসাঁ একটি সময় একটি দেশ বা কয়েকটি দেশ মিলে এই ধরণের এক একটি সাংষ্কৃতিক সৃষ্টির ধারা বয়ে এনেছে।  ইটালির রেনেসাঁর সময়কাল দুই শতক।  ইউরোপের ক্ষেত্রে রেনেসাঁ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটি মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এই রেনেসাঁসের ভেতর দিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থান ঘটেছে এবং একইসঙ্গে অবসান ঘটেছে মধ্যযুগের। প্রচলিত অর্থে রেনেসাঁ প্রাচীন যুগের গ্রিক ও রোমান সাহিত্য , সংস্কৃতি , দর্শন , প্রযুক্তি , বিজ্ঞান , শিল্পকলা , ভাস্কর্যকলা প্রভৃতিতে এক নতুন হাওয়া, উন্নতর হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল। যেমনটি ঘটেছিল এই বাংলায়।প্রাচীন কালে এইসব বিদগ্ধজন পুস্তক, লিপি অধ্যয়নের অনুশীলন বৃদ্ধির যুগ।

এই সময় রাজকীয় ও ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতার উত্থান, চিত্রকলায় দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার এবং বিজ্ঞানের সামগ্রিক উন্নতির যুগ। অর্থাৎ , আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার উন্মেষ ও বিকাশ এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের সামাজিক জীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে, সেটাই ছিল রেনেসাঁ। এইসময়ে ঘটেছিল ইসলামিক দেশে রেনেসাঁ যা ছিল এক স্বর্ণযুগ। রেনেসাঁ পরবর্তী বঙ্গজ শিল্পীদের একে একে মহাপ্রয়াণ কি কোন সঙ্কেত বয়ে আনছে! হয়ত বা আরেকটি রেনেসাঁর সঙ্কেত। নতুন যুগের শুরুর ঈঙ্গিত।।

সুকুমার দেবনাথ, প্রখ্যাত সাংবাদিক।