দেবদাসের মঞ্চে প্রত্যাবর্তন

0
239

জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যে কথাশিল্পী বললে একজনেরই নাম সবার আগে আমাদের মাথায় আসে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বহু লেখাকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে নাটক হয়ে ওয়েবসিরিজ পর্যন্ত। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সকলেই জানি তাঁর লেখা কতখানি প্রাসঙ্গিক আজকের দুনিয়াতেও প্রাসঙ্গিক।

আর এইরকমই কালের গণ্ডি ভেঙ্গে দেওয়া তাঁর আরেক অমর সৃষ্টি ‘দেবদাস’। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যে লেখাগুলিকে ভিত্তি করে ছবি হয়েছে তার মধ্যে ‘দেবদাস’ উপন্যাসকে ভিত্তি করে সব থেকে বেশি ছবি হয়েছে। আর মজার ব্যাপার হল, সেই তালিকায় এবার যোগ হল, ‘অন্য থিয়েটার’এর প্রযোজনা ‘ভালবাসা কারে কয়’।

- Advertisement -

নির্দেশক দেবাসিশ শুধুমাত্র নাটকটির নাম কিঞ্চিত পরিবর্তনই করেননি, চমক এনেছেন গঠনশৈলীতেও। যেমন এই নাটকের নির্মাণ হয়েছে ‘ব্ল্যাক বক্স’ থিয়েটারশৈলীর মাধ্যমে। অসম্ভব কল্পনাশক্তি দেবাশিসের। এবং তার প্রতিফলন হয়েছে মঞ্চে। ২৪ জন অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের নিয়ে প্রযোজনা করলেন ‘ভালবাসা কারে কয়’। সল্টলেকের ‘অন্য থিয়েটার’এর ‘কৃষ্ণকক্ষ ব্ল্যাকবক্স’ রঙ্গমঞ্চে মঞ্ছস্থ হচ্ছে এই নাটক।

‘দেবদাস’ মূলত দেবদাস আর পার্বতীর প্রেমের উপাখ্যান। অথচ এই উপাখ্যানকে আধুনিক সময়োপযোগী করে মঞ্চে বুনতে গিয়ে, নির্দেশক নিয়ে এসেছেন মোট তিন জন দেবদাস ও তিন জন পার্বতীকে এবং তাঁদের প্রতীক হিসেবে তাদেরই হাতে পুতুলের ব্যাবহার, যা তাঁদের প্রতীক হিসেবে যন্ত্রণা সহ্য করে চলে প্রতিনিয়ত। আর প্রতীক হিসেবে চরীত্রেরই হাতে পুতুলের ব্যাবহার, আলাদা করে নির্দেশকের মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়।

দেবদাস ও পার্বতীর ভুমিকায় প্রত্যেকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল এবং অনবদ্য। এরা প্রত্যেকে চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রত্যকটি চরীত্রকে করে তুলেছেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত। আর সব থেকে মজার ব্যাপার হল, যেহেতু এই নাটকের নির্মাণ ব্ল্যাকবক্স থিয়েটারশৈলীতে, ফলত চরীত্রদের প্রবেশ ও প্রস্থান সম্পর্কে দর্শকদের আগে থেকে কোন কিছু আন্দাজ করা সম্ভব নয় যার ফলে এই নাটক গতি পায় তার নির্দিষ্ট সমাপ্তিতে পৌঁছনোর। এছাড়াও যেটা বলার, এখানে প্রত্যেকেই যাকে বলা হয় ‘ডিরেকটার’স অ্যাক্টরস’। কিন্তু তার মধ্যেও যাঁদের অভিনয় আলাদা করে উল্লেখ্য, তাঁরা হলেন, রায়তী ভট্টাচার্য্য, পবিত্র বসু, স্বাতী গাঙ্গুলি, দেবরাজ ভট্টাচার্য্য, কৃষ্ণা দাস প্রমুখেরা।

অবাক হয়ে দেখতে হয় ওই একটুকরো ঘর, কখনো জমিদার বাড়ি, কখনো পথ বা কখনো পুকুর ঘাট হয়ে উঠছে অবলীলায়, তাও শুধুমাত্র কয়েকটি জিনিসের অদল বদল ঘটিয়ে, কুর্নিশ নির্দেশক দেবাশিসকে ও তাঁর ‘স্পেস থিয়েটারশৈলী’কে।

এই নাটকের আরেক বড় সম্পদ হল গান, বা নজরুলগীতির উল্লেখযোগ্য ব্যবহার, যার পুরধা হলেন রায়তি ভট্টাচার্য্য। এই নাটকের সঙ্গীত সংযোজন তাঁর। একই সঙ্গে মুগ্ধ হতে হয় চন্দ্রমুখির ভুমিকায় তাঁর গাওয়া গানগুলি। যেমন দখল তাঁর অভিনয়ের ক্ষেত্রে, তেমনি মুগ্ধকরণ তাঁর গায়কী। আর সেই জোরেই আমরা যেন ফিরে যাই সেই ‘মুজরা’র আসরে। আবার বড় পার্বতীর ভুমিকায় রিষ্টি রায় মোহিত করে রাখেন স্বশ অবধি দর্শকদের।

সব শেষে বলার, বা ধন্যবাদ জানানোর, নির্দেশক দেবাশিসকে। কারন বহুবার নির্মিত এই নাটক আবারও যে তুলনার সম্মুখীন হবে সেটাই স্বাভাবিক। আর এই সব পেরিয়েই একবারে আধুনিক আঙ্গিকে দেবাশিস নির্মাণ করেছেন এই নাটক। যা অবশ্যই এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। তাই নির্দেশক ও কলাকুশলী প্রত্যককেই অভিনন্দন এই রকম একটি দৃঢ় ও দৃপ্ত প্রযোজনা আমাদের উপহার দেওয়ার জন্যে।