স্মৃতির আকাশে ‘উত্তম’ ধ্রুবতারা

0
633

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা: মহানায়ক। শুনলেই বাঙালি মনে দোলা দিয়ে যায় একটি নাম। সেই নামের ওজনেই ওজনদার ছিল টলিউড ইন্ড্রাস্ট্রি। শুধু টলিউড বললে ভুল হবে, বলিউডেও ছিল তাঁর সমান যাতায়াত। তাঁর সিনেমা মুক্তি পাওয়া মানে হলে উপচে পড়া ভিড়। তিল ফেলার জায়গার থাকত না। তাঁর নামেই অর্ধেক টিকিট বিক্রি হয়ে যেত নিমেষে। হ্যাঁ নামটাও সেই অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। থুড়ি উত্তম কুমার।

নারীর মনে উত্তাল করতে এই নাম যথেষ্ট। শুধু নারী কেন পুরুষদের মধ্যে ছিল উত্তম কুমারের মতো হওয়ার বাসনা। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতিফলনে আলোকিত হতে চান সকলে। ১৯৭০-এর পর নায়ক উত্তম থেকে হয়ে গেলেন মহানায়ক। অনাবিল হাসি, অকৃত্রিম চাহনি আর অভিনয় গুণে কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে আজও বাঙালির চেতনায় উত্তম জীবন্ত।

- Advertisement -

সেইসময় উত্তমকুমারকে নিয়ে চলত আরেক লড়াই। তাঁর বয়স হলে কেমন দেখতে হবে তাঁকে? বয়সকালে বাবা, জ্যাঠা, দাদুর রোলে কেমন লাগবে? কিন্তু সেই লড়াই অসমাপ্ত রেখেই ১৯৮০ সালে আজকের দিনে পাড়ি দিলেন পরলোকে। আর আশ্চর্যের বিষয় তাঁর মর্জায় যেভাবে অভিনয় ঢুকে গিয়েছিল, সেই অভিনয়ের সেটেই তিনি রেখে যান তাঁর শেষ কাজ ‘ওগো বধূ সুন্দরী’কে।

এইদিন তাঁর প্রয়াণে সহস্র মানুষ পথে নামেন। সেদিনের কলকাতার ট্রাফিক ছিল স্তব্ধ। কলকাতার প্রাণটাই বেরিয়ে গিয়েছিল। জীবন্ত কলকাতা মর্মে মরে গিয়েছিল ১৯৮০-র ২৪ জুলাই। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল মিছিল করে হাঁটছিল। আর মনে বাজছিল, ‘এই পথ যদি না শেষ হয় কেমন হত…?’ একসময়ে পথ শেষ হয়ে যায়, শেষ হয়ে যায় এক জীবন্ত আর্কাইভ। শুধু থাকে অজস্র স্মৃতি।

উন্নতি, নাম, যশ, খ্যাতির শিখরে জীবন শেষ হলেও শুরুটা ছিল অন্যরকম। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। অভাব-অনটনের সংসার। কোনওমতে দিন কেটে যায়। গিরিশ মুখোপাধ্যায় রোডের একটিমাত্র ঘরে তাঁরা থাকতেন। পয়সার জন্য পড়াশুনার পাশাপাশি শুরু করেন গানের শিক্ষকতা। মজার বিষয় তাঁর সাত পাঁকে বাঁধা পড়া এই গানের শিক্ষকতার জীবন থেকেই। গানের ছাত্রী গৌরী দেবীকেই নিজের সংসারের ভার তুলে দেন মহানায়ক।

মহানায়কের অভিনয় জীবনের শুরুতে ছিল না কোনো সফলতার গল্প। একের পর এক সিনেমা মুখ থুবড়ে পড়েছে বক্স অফিসে। কানাঘুষা চালু হয় ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ নাম। ফ্লপের পরেও সিনেমায় সুযোগ পাওয়ায় ঈর্ষার কারণও হয়েছিলেন তিনি। তবে সেইসব দিকে চোখ কান না দিয়ে মনোযোগ দিয়েছিলেন কঠোর পরিশ্রমের দিকে। তাঁর সেই ফ্লপের দুর্নাম ঘুচল ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। নায়কের ভূমিকায় নয়, ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে। ছবিটি বেশ ভাল চলল, অভিনয়ের জন্য প্রথম প্রশংসিত হলেন উত্তম।

‘সাড়ে ৭৪’-এর জোয়ারের ঢেউ গিয়ে পড়ল পরের বছর। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পেল উত্তম অভিনীত ১৪টি ছবি, তার মধ্যে সাতটিই সুচিত্রার সঙ্গে জুটি বেঁধে। ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াইশ’ ছবিতে অভিনয় করেছেন উত্তম। সেই ২৫০ ছবি আজ বাংলা সিনেমার আর্কাইভ। সিনেমার কুঠিরে সাজানো আছে এই উজ্জ্বল তাঁরা। আজও বাঙালি মনে চির যুবক উত্তম। নতুন প্রজন্মও তাঁকে সমাদরে গ্রহণ করেছে। করবেই না বা কেন তাঁর উজ্জ্বলতা তো এতটাই। তাঁর আলোয় আজও আলোকিত টলিউড।