Home পোস্ট এডিট লাউ চিংড়িতে লাউ বেশি হলে লোকে যে ছিছি করবে, বলেছিলেন সৌমিত্র

লাউ চিংড়িতে লাউ বেশি হলে লোকে যে ছিছি করবে, বলেছিলেন সৌমিত্র

0

কীর্ত্তীশ তালুকদার: ব্যাপারটা যে ঠিক কী হয়েছিলো, আজও বুঝতে পারি না। আজও খানিক হতভম্ব লাগে।

শুরু হয়েছিলো এক রবিবার সকালে। দিল্লি থেকে শ্রী সন্দীপ বাঁড়ুজ্জের ফোন। একটা কাজের বরাত দিলেন। সরষের তেলের জিঙ্গল লিখতে হবে। লিখলাম। আবার ক’দিন পর ফোন। বললেন, অ্যাপ্রুভড। এবার গাওয়াতে হবে। বললাম, বেশ। কিন্তু কে গাইবে? নামকরা কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনা হলো। তারই মধ্যে একজনকে ঠিকও করা হলো। আমিও অন্যদিকে টিমকে জানালাম। আমি, আশু, মৈনাক। আমরা তৈরি।

পরদিন আবার ফোন। উনি, মানে সন্দীপবাবু, মানে বাপ্পাদা বললেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। জিঙ্গলটা গাইবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বললাম, বেশ। কবে, কখন, কোথায় রেকর্ডিং হবে? উনি বললেন, সে তো তুই বলবি। শুনে আমার এক গাল মাছি। বললাম, এই যে বললে ঠিক হয়ে গেছে? অম্লান বদনে তিনি বললেন, কে গাইবেন ঠিক করে ফেলেছি। বাকীটা তুই দেখে নে।

মনে হলো যেন কোনও প্রশ্ন কমন না আসা একটা প্রশ্নপত্র হাতে ধরে পরীক্ষার হলে বসে আছি। ভেবে দেখলাম, না ঘাঁটিয়ে ডুব দেওয়াই শ্রেয়। তাই দিলাম। কিন্তু এই সন্দীপবাবুর কব্জা থেকে পালানো খুব কঠিন। উনি আমাকে পাড়ার মোড়ের আড্ডার মাঝপথে কলার ধরে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে চাকরিতে বসিয়েছিলেন এমনই নাছোড়বান্দা। ফোন না ধরে পালাতে পারবো না এমন একটা আশঙ্কা ছিলোই। যখন বুঝতে পারলাম উপায় নেই, তখন আশু আর মৈনাকের কাছে সারেন্ডার করলাম। আমার অজস্র অত্যাচার আশু ছোট ভাইয়ের মতো মুখ বুঁজে সয়ে এসেছে। এবারে রিভোল্ট করলো। চ্যাংড়ামির একটা লিমিট আছে কীর্ত্তীশদা, গজগজ করতে করতে ফোন রেখে দিলো। মৈনাক ফোনে ব্যাপারটা শোনার পর ফোনটা আদৌ ধরে আছে কিনা বুঝতে আমাকে পরপর সতেরোবার হ্যালো বলতে হলো।

কিন্তু কী করা যায়? অতঃপর মামা, মানে নীলাঞ্জন। আমার ছেলেবেলার, এবং এখনও আমাকে ত্যাজ্য না করতে পারা বন্ধুদের একজন। এডিটর। ওর পায়ে গিয়ে ডাইভ দিলাম। মামার বড় মামা, মানে আমাদেরও বড় মামা মস্ত মানুষ; এবং ব্যস্ত মানুষ। তবে তিনি কোনওদিনই ভাগ্নে ও ভাগ্নের বন্ধুদের মধ্যে ফারাক দেখেননি। এছাড়াও বড় মামার একটি বিশেষতঃ আছে। বড় মামা লিপইয়ারে হাসেন। চার বছরে একবার। সে যাই হোক, বড় মামা ভাগ্নের এই অসহায় অবস্থা দেখতে না পেরে গম্ভীর মুখে বললেন, দেখছি।

বড় মামার ফোন পেয়ে একদিন গেলাম টেকনিশিয়ান্স। ওঁর ঘরেই বসলাম। বসে আছি। বসেই আছি। বসে আছি তো আছিই। হঠাৎ দরজায় আওয়াজ। এবং তাঁর প্রবেশ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কথা বলবো কী? এমন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা হয়তো কলেজের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী যদি আমায় হাতে হাতে প্রেমপত্র দিতেন, তাহলেও হতো না।

সব শুনলেন। তারপর বললেন, গান গাইতে হবে? বিজ্ঞাপনের গান? আমি তো কখনও… খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো বললাম, মানে ইয়ে স্যার, জানি তো আগে গাননি কখনও। তাই জন্যেই যে আপনাকেই চাই। একটু ভেবে বললেন, বেশ। বাড়ি এসো। কথা হবে।

ফ্যানবয় অবস্থা কাটিয়ে গেলাম ওঁর বাড়ি। বললাম। শুনলেন। বোঝালাম। বুঝলেন। এবং রাজি হলেন। বিজ্ঞাপনে প্রথমবার জিঙ্গল গাইতে রাজি হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

আমার তখন মনে হচ্ছে ‘উপড়ায়ে আনি কারাকোরামের চূড়া’। যে কোনও কাজ, সব পারবো। ফোন করলাম আশুকে। শুনে ব্যাটা যেন কিছুই হয়নি এমন ব্রহ্মানন্দ ক্যাজুয়াল গলায় বললো, তাহলে এগিয়ে যাও। আমি বাকীটা দেখে নিচ্ছি। মৈনাকও তাই। পাত্তাই দিলো না। দিল্লির বাদশাহ সন্দীপবাবু? তিনি বললেন, ওক্কে। গুডও না। স্রেফ ওক্কে।

আসলে এটা ইচ্ছে করেই করেছিলো সবাই। নিজেদের তো বটেই, এমনকী আমাকেও ওই ফ্যানজোন থেকে বের করে আনার প্রয়োজন ছিলো। কারণ উল্টোদিকের মানুষটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

শুরু হলো কাজ। বাড়িতে ডেকে পাঠাতেন। হয় দুপুরে, নয় রাত্রে। আমি যতোবার ওঁর কাছে স্ক্রিপ্ট নিয়ে গেছি শোনাতে, শুনেছেন। আলোচনা করেছেন। চাপিয়ে দেননি। বলতেই পারতেন, আমি এইভাবে করবো। যদি বলতেন, আমাদের কিছু বলার থাকতো না। কিন্তু বলেননি। একদিন আশুকে বললাম, আমি একটা সুর ভেবেছি। আশু ছবি বিশ্বাসের মতো ভ্রূভঙ্গী করে বললো, আবার সুরও ভেবেছো? বেশ। শোনাও। দুকলি ভাঁজতেই মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বললো, থাক থাক। আবার সৌমিত্রবাবুকে গেয়ে শোনাতে যেও না। উনি গান কেন, ডায়লগও ভুলে যেতে পারেন। তবু সাহস করে এই ভাঙা কাঁসী গলায় জিঙ্গলটি গেয়ে শুনিয়েছি। সেই অত্যাচারও সহ্য করেছেন। মহড়া দিয়েছেন বাড়িতে। স্টেজে মারতে চাননি। চেয়েছিলেন তাঁর প্রথম বিজ্ঞাপনের গান যেন নিখুঁত হয়। সব থেকে বড় কথা, সৌমিত্রবাবুও প্রজেক্টটায় একইভাবে জড়িয়েছিলেন। গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স দেননি।

আর আমরা? আমরা তখন একটা ট্রান্সের মধ্যে। কী হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে, কেন হচ্ছে জানি না। শুধু জানি একটা বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল হবে। যা গাইবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ওঁর গাওয়া প্রথম জিঙ্গল।

রেকর্ডিংয়ের দিন সকালে এলেন ক্লায়েন্টের তরফ থেকে সঞ্জীবদা। বরাভয় দিলেন, তোরা যা করবি তাই হবে। আমি নাক গলাবো না। আমরা নাক সিঁটকোলাম। জানা আছে। সবাই অমন বলে। কিন্তু সত্যিই গলাননি।

শুরু হলো রেকর্ডিং। কাচের ঘরের ওদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁকে ‘সৌমিত্রবাবু, এই জায়গাটা হচ্ছে না’ বলতে ইতস্ততঃ করিনি আমরা। কারণ উনি সেটা পছন্দ করবেন না ততোদিনে বুঝে গেছি। নিজেই নানান টেক দিচ্ছেন। আবার নিজেই বলছেন, আগেরগুলো ফেলে দাও। গুলিয়ে ফেলবে। নতুন করে দেবো। চলো।

গান হলো। রেকর্ডিং হলো। আড্ডা হলো। সব হলো। কাজের ভিডিও রেকর্ডিং হলো। কিন্তু একসঙ্গে ছবি তোলা হয়েছিলো কিনা, মনে নেই। উনি কারওর কাঁধে হাত রেখে কিছু বলেছিলেন কিনা, মনে নেই। কারওর দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন কিনা, চায়ে দুধ দিতে বলেছিলেন কিনা, লেবু চা চেয়েছিলেন কিনা, রুমাল দিয়ে মুখ মুছেছিলেন কিনা, কিচ্ছু মনে নেই। থাকা সম্ভব? চোখের সামনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখন চারপাশে কী হচ্ছে, মনে রাখা সম্ভব? আমরা শুধু দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা করে চলেছি আদ্যন্ত পেশাদার থাকার। সে যে কী কষ্ট, কী বলবো। সমানে মনে হচ্ছে, ধুত্তোর রেকর্ডিং। আপনি কে তুমি নন্দিনীর ওই ট্যুইস্ট কী করে নেচেছিলেন তাই বলুন তো। কিংবা মগনলালের ডেরায় নোটের তাড়াটা কি একবারে ঘণ্টির ওপর ফেলেছিলেন? রিটেক করতে হয়েছিলো কিনা, বলুন না? কিন্তু ফোকাস নড়লে চলবে না। তাই লড়ে যাচ্ছি তখন, নিজেদের সঙ্গে।

মারিও গোৎসেকে মনে আছে? ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে শেষ মিনিটে নেমেই ধাঁই করে গোল। নিজেও বোঝেননি কী করে ফেললেন। কিংবা রমন লাম্বা। ইমরান খানকে পয়েন্টের ওপর দিয়ে ছক্কা। হতভম্ব ইমরান প্রেসের সামনে বলেছিলেন, ও নিজেও জানে না ও কী করে ফেলেছে। আমাদেরও তেমন অবস্থা। নিজেরাও জানি না কী করে ফেলেছি। একটা গোটা বিজ্ঞাপনের গান, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে গাইয়ে ফেলেছি। উনি যখন বললেন, তোমরা তাহলে আমাকে গায়ক বানিয়ে তবে ছাড়লে, তখন খানিক সম্বিত ফিরলো। আশু, মৈনাক, আসিফ, সৌরভ, সৌমী, আমি, মায় নীলাঞ্জনা, আমরা সবাই তখনও লেবড়েজুবড়ে আছি।

প্রোজেক্ট শেষ হলো। আমরাও দিনকয় পর একটু একটু করে স্বাভাবিক হলাম। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া বিজ্ঞাপনের প্রথম জিঙ্গলের কথা কোথাও সেইভাবে বুক বাজিয়ে বলতে পারলাম না। ছাপোষা মধ্যবিত্তের দল আমরা। কোথাও একটা কুণ্ঠাবোধ কাজ করতো, নিজেদের ঢাক পেটাতে। মনে হতো, কাজ ভালো হলে মানুষ এমনিই জানবে। জানানোর কি আছে? আজ যখন সেই কাজ মাঝে মাঝেই সোশাল মিডিয়াতে ভেসে ওঠে, ভালো লাগে।

আমাদের সেই টিমের কেউ পরবর্তীকালে সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি। নববর্ষ কী ক্রিসমাসে মেসেজ করিনি। যদি করতাম, উনি উত্তর দিতেন, নিশ্চিত। সখ্যতা ততোটাই ছিলো। তবু ভয় করতো, যদি বিরক্ত হন? বিরক্ত হলেও জানতে পারতাম না যদিও। ওই যে বললাম, মধ্যবিত্ততা। সবার কাছেই কিন্তু ওঁর মোবাইল নম্বর ছিলো। তাও করিনি। আসলে আমরা, আমাদের সেই টিমের সবাই আমাদের এই আইকনের প্রতি দূর থেকেই সশ্রদ্ধ ছিলাম। হয়তো ভাবতাম, কাছে গেলে যদি সেই অরা ভেঙে যায়?

আর হ্যাঁ, দাদা বলার চেষ্টাও করিনি। স্যারও বলিনি। আমরা ওঁকে সৌমিত্রবাবু বলেই সম্বোধন করেছি প্রজেক্টের আগাগোড়া। নিজেদের মধ্যে আলোচনাতেও।

এখনও মনে আছে ওঁর সেই কথাটি। লাউটা বেশি হলো? লাউ চিংড়িতে লাউ বেশি হলে লোকে যে ছিছি করবে আমাকে। তাই আরেকবার নিয়ে নাও। ভালো থাকবেন সৌমিত্রবাবু। আপনার সঙ্গে করা ওই একটি প্রজেক্ট আমরা চিরকাল খুব যত্নে রেখেছি, নিজেদের মনে। চিরকাল রাখবো।

কীর্ত্তীশ তালুকদার

পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা। সাত ঘাটের জল খেয়ে বিজ্ঞাপনে থিতু তাও অনেক বছর। কলকাতার আগমার্কা রকাফেলার। প্রিয় বেড়ানোর জায়গা মাছের বাজার। নেশা আড্ডা।

Exit mobile version