
শান্তি রায়চৌধুরী: ২৭ অগাস্ট, ১৯৫৯ সাল। ফ্রান্সের দিক থেকে সমুদ্র নামলেন এক বাঙালি তরুণী। উদ্দেশ্য— ইংলিশ চ্যানেল পার করবেন তিনি।
শুরুতেই সব শেষ:
প্রায় ১৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতার কাটার পরে গন্তব্যে পৌঁছতে তখন বাকি মাত্র ৩ মাইল। বোটম্যান ঘুরপথে নিয়ে গেলে তরুণী স্রোতের বিপরীতে পড়ে যান। আর এগোতে পারছেন না দেখে বোটম্যান তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ব্যস, বাঙালি মেয়েটির স্বপ্ন এখানেই শেষ। নিয়মানুয়াযী কেউ সাঁতারুকে স্পর্শ করলে সে বাতিল হয়ে যায়। নৌকায় উঠে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন তরুণীটি। হবেই তো! কাছে এসেও যে স্বপ্নের সমাধি ঘটেছে!
খাস খবর ফেসবুক পেজের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/khaskhobor2020/
হ্যাঁ, বলছিলাম ১৯৫২ সালের হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু আরতি সাহার কথা। কিন্তু ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার জন্য তাঁর মন যে তোলপাড় করছে। কিন্তু সমস্যা হল অর্থ। দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা অনুশীলন, ইস্টার্ন রেলের ১৪৪ টাকার মাইনের চাকরি আর টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে খালি হাতে ঘরে ফেরা। এই ছিল তার দৈনন্দিন কাজ। শেষ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হল।
অল ইন্ডিয়া স্পোর্টস কাউন্সিলের সদস্য পঙ্কজ গুপ্ত তাঁকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য পাঠালেন। চ্যানেল পার হওয়ার কথা শুনে যিনি বলেছিলেন, “ইংলিশ চ্যানেল চোখে দেখেছ যে পার হবে বলছ?” পরে অবশ্য তাঁর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “সকালে টাকা পৌঁছে যাবে। হাসি মুখে ফিরতে পারবে তো মা?”
মুষড়ে পড়া মেয়েটির মুখে আরও হাসি ফোটালেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মিহির সেন, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অতুল্য ঘোষ, সমাজসেবী শম্ভুনাথ মুখোপাধ্যায় এবং চিকিৎসক অরুণ গুপ্ত। তাঁরা প্রত্যেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁদেরই ঐকান্তিক উৎসাহ এবং সাহায্যে, আর একমাস কঠোর অনুশীলনের পর আবার সেই ফ্রান্সের উপকূলে আরতি পৌঁছালেন ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে।
এল সেই শুভক্ষন। ভোর ৫ টা ৫৫ মিনিট। জলে নামলেন আরতি। কেপ গ্রিস নে থেকে । আঁকাবাঁকা পথে সাঁতরে ৪২ মাইল পথ অতিক্রম করে উঠতে হবে ইংল্যান্ডের ফকস্টোনে। তাঁর গাইড ছিলেন ক্যাপ্টেন হার্টিনসন। ফকস্টোন থেকে ৫ মাইল দূরে স্যান্ডগেটে বোট থেমে গেলেও নিয়ম অনুযায়ী আরও ১০ গজ হেঁটে যেতে হয় প্রতিযোগীদের। অবশেষে ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিটে চ্যানেল পেরিয়ে প্রথম এশীয় মহিলা হিসাবে রেকর্ড করলেন মাত্র উনিশ বছরের কলকাতার হাটখোলা ঘাটের মেয়ে আরতি সাহা।
ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার পর প্রথম শুভেচ্ছা আসে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, বিধানচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে। আরতি সাহা ও তাঁর স্বামী অরুণ গুপ্তকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দিল্লির তিনমূর্তি ভবনে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হন। তিনিই ক্রীড়া জগতের প্রথম মহিলা, যাঁর স্মরণে ১৯৯৯ সালে ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়।
আরও পড়ুন: CSK vs RCB : যুবরাজের সঙ্গে তুলনা নিয়ে মুখ খুললেন শিবম দুবে
অবশেষে জন্ডিস এবং এনকেফেলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৩ অগাস্ট মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি জীবন সাগর সাঁতরে চলে যান অমৃতলোকে। ভারতের সর্বকনিষ্ঠ বাঙালি অলিম্পিয়ান সাঁতারু এবং ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া আরতি সাহাকে আজও বাঙালি মনে রাখেননি। বছরের পর বছর ২৯ সেপ্টেম্বর দিনটা আসে, কিন্তু বাঙালির কাছে এই কীর্তিমান সাঁতারু উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছেন।