সুমন বটব্যাল: এখানে নেই এর তালিকা দীর্ঘ৷
জলাভাবে চাষ হয় না৷ গায়ে গতরে পরিশ্রমের মুরোদ রয়েছে, কিন্তু বছরভর কাজের ব্যবস্থা নেই৷ পানীয় জলের ট্যাব থেকেও নেই৷ কারণ, ঘটা করে এলাকায় বসেছিল হ্যান্ড পাম্প৷ উঠেছে ছবি৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই পাম্পের মুখ দিয়ে একফোঁটা জলও পড়তে দেখেননি বাসিন্দারা৷ অগত্যা, ফোর-জির যুগেও কয়েক কিমি পথ উজিয়ে কলসিতে করে খাবার জল সংগ্রহ করতে হয় মহিলাদের৷ রাস্তা আছে, তবে খানাখন্দে ভরা সে রাস্তায় অমাবস্যার রাত নয়, সূর্যের আলোতেও চলাচল করতে গেলে হোঁচট খেতে হয়!
আরও পড়ুন: ব্যক্তিস্বার্থে সরকারি পুকুরের মাছ বিলিয়েছেন মন্ত্রী, তদন্তের দাবি অনির্বাণের
প্রতিশ্রুতি ছিল, ঘরে ঘরে পানীয় জল, শৌচালয়, পাকা রাস্তা, স্থায়ী নিকাশি ব্যবস্থার৷ আশায় বুক বেঁধেছিলেন ঘরপোড়া গ্রাম্য মানুষগুলো৷ কিন্তু লাল পেরিয়ে জোড়া ফুলের জমানাতেও ভূমিষ্ঠ হতে পারেনি প্রতিশ্রুতিগুলি৷ এরই মাঝে দোড়গড়ায় হাজির আরও একটি ভোট৷ দোনামনা করতে করতে মোক্ষম কথাটা নাগাড়ে বলেই ফেললেন তিন কুড়ি হতে দু’গজ দূরে থাকা পূর্ণিমা বাগদী, ‘‘বাবা, তোমরাও ওদের মতো হবে না তো! আমরা অবশ্যই তোমাদের দেখব, কিন্তু তোমরাও দেখবে তো? ভোটের পর ভুলে যাবে না তো?’’
আরও পড়ুন: চোরের পিসির বড় গলা, মমতাকে কটাক্ষ অনির্বাণের
ছিপে ছিপে চেহারার সজ্জন মানুষটি পূর্ণিমার পিঠে হাত রেখে আশ্বাস দিলেন, ‘‘না গো মাসি, তোমাদের দুর্দশা বাড়াতে আসিনি৷ এসেছে দুর্দশা ঘোচাতে৷’’ ইলামবাজারের বিলাতিঞ্চলে তখন মানুষের আকাশ ভাঙা ভিড়৷ কে নেই সেই তালিকায়? শুরু হল কলরব৷ কেউ বললেন জলাভাবের কথা, কেউ শৌচালয়ের কথা৷ কেউ শোনালেন সর্পিল রাস্তার বর্ষায় ভয়ঙ্কর রূপের কথা৷ কেউ শোনালেন হ্যান্ড পাম্পের দুরাবস্থার কথা৷ এক মহিলা বললেন, ‘‘জানেন, আমাদের গ্রামে প্রত্যেকের বাড়িতে সরকারি বাথরুম স্যাংশন হয়েছে৷ তবে সেটা খাতায় কলমে!’’ মুহূর্তে হাসির রোল উঠল ভিড়টাতে৷
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর ভাষা বাঙালির সংস্কৃতিকে লজ্জা দেয়: অনির্বাণ
শহুরে মানুষটি বললেন, ‘‘২০ বছর আগে গুজরাটেও এই হাল ছিল৷ আর এখন দেখুন সারা বিশ্ব গুজরাটকে ফলো করছে৷’’ প্রখর তাপদাহকে উপেক্ষা করেই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পাড়ি দিচ্ছেন বিজেপি প্রার্থী ড: অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়৷ কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বা সওয়ার হচ্ছেন বাইকে৷ গ্রামের বটগাছের ছায়ার আড্ডা থেকে গেরস্থের রন্ধনশালা পর্যন্ত ঢুঁ মারছেন দেরাদুনে ঋষি অরবিন্দের আশ্রমে বেড়ে ওঠা সেদিনের শিশুটি৷ লক্ষ্মীবারে চষে বেড়ালেন ইলামবাজারের বিলাতিঞ্চলের পূর্ব নারায়ণপুর, মহেশ্বরপুর এবং ধরমপুর অঞ্চলের তাতালপুর কলোনী৷
হাজারো মাটির ঘরের ভিড়ে দেখা মিলল প্রধানমন্ত্রী আবাসর যোজনার একটি পাকা বাড়ি৷ গ্রামের বাসিন্দাদের কথায়, ‘উটা মোদীর বাড়ি৷’ একগাল হেসে অনির্বাণ বললেন, ‘‘গ্রামের সকলেরই প্রাপ্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের এই বাড়ি৷ কিন্তু এরা নিজেরাও কাজ করেনি, আমাদেরও কোনও কাজ করতে দেয়নি৷’’ ভিড় থেকে তখন আওয়াজ উঠেছে, ‘কারচুপির সরকার, কাটামানির সরকার, আর নেই দরকার৷’
ফি-বারের ভোটে নিত্য নতুন দাওয়ায় দেওয়ার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠা অনুব্রত মণ্ডল এবারেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘‘খেলা হবে, ভয়ঙ্কর খেলা হবে৷’’ জবাবে অনির্বাণ বলছেন, ‘‘যাঁরা ক্ষমতা অপব্যবহার করে, মানুষের সেবা করে না, তাঁরা আর যাই হোক গুরুদেবের ভক্ত হতে পারে না৷’’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, বোলপুর বরাবরই পরিবর্তনের সঙ্গী৷ বামেদের জমানায় এই মাটি ছিল কার্যত লালেদের শক্তঘাঁটি৷ ১১-য় পরিবর্তনের ঢেউ-এ অবশ্য লালেদের সেই শক্তমাটি ধুয়ে ঘাসফুলের জন্য নতুন পার গড়েছিল বীরভূমের বাসিন্দারা৷
পরিবর্তন নাকি প্রত্যাবর্তন, একুশে কোন দিকে ঝুঁকবে বীরভূম? সোঁদা মাটি জানান দিচ্ছে, বদলাচ্ছে পরিস্থিতি৷ মুখ খুলছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ৷ স্বভাবতই, এক ফুলের মুখ শুকিয়ে হাসি চওড়া হচ্ছে অন্য ফুলের৷ উন্নয়নের স্বপ্নজাল বুনছেন অনিবার্ণও৷ বাড়ি বাড়ি প্রচারের ফাঁকে কর্মীদের বারংবার বলছেন একটাই কথা, ‘‘ভোটের পর কিন্তু দায়িত্ব আরও বাড়বে৷ আরও বেশি করে মানুষের কাছে আসতে হবে৷’’
‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’ আউড়ে শাসকদল তৃণমূলের বীরভূমের অলিখিত ‘মুখ্যমন্ত্রী’ অবশ্য ‘খাস খবরকে’ প্রত্যয়ী কন্ঠে বললেন, ‘‘ভোট করাতে আমি জানি, ২ মে ফলাফলটা মিলিয়ে নেবেন!’’