দিদির জমানা: আতঙ্কের নাম CPM, প্রাণ বাঁচাতে মরা স্বামীকেও অস্বীকার করতে দ্বিধা করেননি বধূ

0
96
chotoangaria case

সুমন বটব্যাল, কলকাতা: ভিড়ে ঠাসা এজলাসে সাক্ষীর কাঠগড়ায় বোরখা পরিহিত এক মহিলা৷ কাশ্মীরা বিবি৷ বোরখার ভিতর থেকে স্পষ্ট, কান্না চাপা দেওয়ার গোঙানি৷ সিবিআইয়ের আইনজীবী তাপস বসুর হাতে একখানা ছবি৷ হায়দার আলি মণ্ডল৷ ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার ছোট আঙারিয়া (Chotoangaria Case) নামক অখ্যাত গ্রামে ঘটে যাওয়া গণহত্যার ‘শহিদ’! এই হায়দার বক্তার আলি মণ্ডলের ভাইপো৷ বক্তারের বাড়িতেই সেই রাতে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল তৎকালীন দোর্দন্ডপ্রতাপ শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে৷ হায়দার সহ নিখোঁজ সাতজনের কারও দেহেরই সন্ধান মেলেনি৷ পরের দিন ভোরে বক্তাবের অগ্নিদগ্ধ বাড়ি থেকে মিলেছিল সামান্য কয়েকটি হাড়গোড়৷ সালটা ২০০৬৷ ছোট আঙারিয়া মামলার শুনানি বসেছে মেদিনীপুর জেলা আদালতের পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা বিচারক উদয়চন্দ্র নাগের এজলাসে৷

সাক্ষীর উদ্দেশ্যে একটা ছবি দেখিয়ে সিবিআই আইনজীবীর সওয়াল-‘এই ছবিটা চিনতে পারছেন? ইনিই তো আপনার স্বামী?’ ছবির দিকে একটুও না তাকিয়ে আগাগোড়া বোরখায় মুখ ঢেকে নীচু হয়ে থাকা মহিলা গোঙানি মিশ্রিত কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বললেন- ‘না, চিনি না!’’ ঘটনার আকস্মিকতায় বিচারপতির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠলেন সিবিআইয়ের আইনজীবী তাপস বসু, ‘দেখুন স্যার, দেখুন! চাপা সন্ত্রাসের নমুণা দেখুন! প্রাণ বাঁচাতে নিজের মরা স্বামীকে পর্যন্ত অস্বীকার করছেন এই মহিলা৷’’ বস্তুত, এভাবেই একের পর এক সাক্ষী বিরুপ হয়ে যাওয়ায় ছোট আঙারিয়া গণহত্যা মামলায় বেকসুর খালাস হয়েছিলেন সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সদস্য তপন ঘোষ, সুকুর আলিরা (দলের তরফ থেকে যাদের সম্পদ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় ঘটিয়ে ফেরার পথে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর! ২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর)৷

- Advertisement -

ঘটনার দেড় দশক পরে তাপসবাবুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘ওই সময় সিবিআইয়ের হয়ে সওয়াল করার সময় আমাকে হেনস্থার মুখোমুখিও হতে হয়েছে৷ কিন্তু স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয়৷ তাই বাম আমলে ছোট আঙারিয়ার মতো একের পর এক গণহত্যা ঘটলেও স্রেফ সাক্ষী এবং প্রমাণের অভাবে বেকসুর হয়ে গিয়েছে অভিযুক্তরা৷’’ শুধু সিবিআইয়ের আইনজীবী নয়, ছোট আঙারিয়া মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত প্রশান্ত পালকে গ্রেফতার করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের মার খেয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল সিবিআইয়ের আধিকারিকদের৷ এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘সোর্স মারফৎ খবর পেয়ে আমরা অভিযুক্তের বাড়ি ঘিরে ফেলেছিলাম৷ গ্রেফতার নিশ্চিত৷ ঠিক এমন সময় একদল গ্রামবাসী আমাদের দিকেই ডাকাত, ডাকাত বলে তেড়ে এল!’’

শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন কেশপুরের ঘোষপুর গ্রামের এক ব্যক্তি৷ মেদিনীপুরে নমিনেশন জমা দিয়ে বাড়ি ফেরার আগেই তাঁর স্ত্রীর হাতে পৌঁছে গিয়েছিল একটি প্লাস্টিক, ভিতরে সাদা থান! ফলস্বরূপ, পরের দিনই ওই প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন৷ যার দরুন, লাল-জমানায় ভোটের আগেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের একাধিক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়ী হতেন বাম প্রার্থীরা৷

নাম প্রকাশ করব না এই শর্তে কেশপুরের তৎকালীন সিপিএমের দাপুটে এক নেতা, বর্তমানে বিজেপির ওই জেলা নেতার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘‘সন্ত্রাসকে সায়েন্টিফিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলাম আমরা৷ তাই ২০০৬ সালের নির্বাচনে বিহারখ্যাত পর্যবেক্ষক কে জে রাও-ও কেশপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট করিয়েও কিস্যু করতে পারেননি৷ কারণ, কোন বুথে কত ভোট পোলিং হবে, কারা কতগুলি ভোট পাবেন, সেটাও আগে থেকেই আমরা ঠিক করে রেখেছিলেন জামশেদ আলি ভবনে বসে!’’

যার নিট ফল, ভোটের আগের রাতে প্রতিটি বুথ এলাকায় বসতো মাংস-ভোজ৷ গ্রামবাসীরা তো বটেই, ভোটের আগের রাতে বুথে পৌঁছানো ভোট কর্মীরাও বুথে বসেই পেয়ে যেতেন গরম ভাতের সঙ্গে দেশি মুরগির ঝোল সহযোগে ‘লাল-আতিথেয়তা’। ভোট কর্মী কিংবা গ্রামবাসী, কেউ বেয়াড়াপনা করলেই মনে করিয়ে দেওয়া হত, ছোট আঙারিয়ার (Chotoangaria Case) ঘটনা৷ ওই সেই যেভাবে ছোট বেলায় মা-ঠাকুমারা বেয়াড়া বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে বর্গী-হানার গল্প শোনাতেন!

আরও পড়ুন: দিদির জমানা: চুরি করা মহাপূণ্য যদি না পড়ো ধরা

আরও পড়ুন: দিদির জমানা: ‘শোবো, কিন্তু কেউ যেন জানতে না পারে’

downloads: https://play.google.com/store/apps/details?id=app.aartsspl.khaskhobor