বাংলা ভাগ কি আদৌ কোনো সমাধান, আবেগ নয় মগজ দিয়ে ভাবুন

0
270

কৌশিক মাইতি, কলকাতা: ধরুন একটা মানুষ ক্ষুধার্ত, তাকে বারবার বোঝানো হচ্ছে তার সব খাবার তার ভাই খেয়ে নিয়েছে, তাই সে খাবার পাচ্ছে না। কিন্তু এদিকে দুই ভাই-ই খেতে পাচ্ছে না বেপাড়ার মহাজনের জন্য। মহাজনের কথায় দু ভাই লাঠালাঠি করে একে অপরকে রক্তাক্ত করছে, মজা লুটছে মহাজন। এটাই বাংলা ভাগের রাজনীতির মূল রসদ।

গোর্খাদের বোঝানো হচ্ছে বাকিরা তাঁদের সব অধিকার কেড়ে নিয়েছে। রাজবংশী, কোচ ভাইবোনেদের বোঝানো হচ্ছে বাঙালি মানে কলকাতার বাঙালি সব নিয়ে নিয়েছে, তাই তাঁরা হকের জিনিস থেকে বঞ্চিত৷ রাজবংশী ভাইদের বলা হচ্ছে ওপার বাংলা থেকে আসা হিন্দু বাঙালিরা এসে চাকরি-বাজার-কাজ-মাটি সব দখল করে নিচ্ছে।

- Advertisement -

হিন্দু বাঙালিকে বোঝানো হচ্ছে তাদের সব সমস্যার কারণ মুসলমান বাঙালি। কিন্তু আসলে সবাই বঞ্চিত, সবাই শিকার-শিকারি মেঘের আড়ালে বসে হাসে শুধু। স্বঘোষিত মহারাজা অনন্ত নিজেকে নতুন রাজ্যের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী ভেবে বসেই আছেন। নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন KLO-র শীর্ষ নেতৃত্ব জীবন সিংহ ও মালখান সিং পরপর বিবৃতি দিচ্ছেন।

কেউ বলছে কামতাপুর রাজ্য চাই, কেউ বলছে গ্রেটার কোচবিহার চাই, গোর্খারা বলছে গোর্খাল্যান্ড চাই, বিজেপি বলছে পুরো উত্তরবঙ্গ আলাদা চাই। কামতাপুর লিবেরেশন অর্গানাইজেশন KLO তৈরি হয় ১৯৯৫ সালে এবং কামতাপুর পিপলস পার্টি KPP তৈরি হয় ১৯৯৭ সালে। সর্বোচ্চ লক্ষ্য-পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের ছটা জেলা এবং আসামের পশ্চিমাংশের কটা জেলা এবং বাংলাদেশের কিছু অংশ নিয়ে মানে ভারত ভেঙে স্বাধীন কামতাপুর রাষ্ট্র গঠন।

লড়াই আন্দোলন চলছিল, তবে ঝিমিয়ে পড়েছিল অনেকটাই। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে মালদহ উত্তর থেকে কোচবিহার এই অংশে পরপর ৭ টা লোকসভা সিট জেতে বিজেপি। তারপর থেকেই শুরু হয় ক্ষোভের রাজনীতি, “উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত” বলে হাওয়া তোলার চেষ্টা শুরু হয়। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদকেও কলকাতার ব্র‍্যাকেটে ফেলে বলা শুরু হয় কলকাতা সব নিয়ে নিয়েছে।

প্রয়াত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির স্বপ্নের AIIMS রায়গঞ্জ থেকে কল্যানীতে স্থানান্তরিত করে ঐতিহাসিক ভুল করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নিয়ে ক্ষোভ ছিল বিস্তর, কারণ সব বড় হাসপাতালই কলকাতায় ও তার আশেপাশে। ক্ষোভের কারণ একদম ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত। এই ক্ষোভকেই আরও উস্কে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা শুরু করে আরএসএস ও বিজেপি।

যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম সংস্থান সবদিক থেকে পিছিয়ে ‘উত্তরবঙ্গ’, বিজেপি আলাদা রাজ্য দেবে, সব সমস্যা মিটে যাবে, বিপুল উন্নয়ন হবে- এমন সব গল্প ভেতর ভেতর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বিজেপির ক্ষোভের রাজনীতি, তৃণমূলের দুর্বল সংগঠন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, এনআরসি, নাগরিকত্ব আইন এই সমস্ত কারণে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং ২০২১-এ তিন জেলায় মাত্র ৪ টি বিধানসভা আসন জেতে তৃণমূল।

বাংলার অধিকাংশ জায়গায় তৃণমূল ভালো ফল করলেও এই জেলাগুলোতে বিজেপির সঙ্গে পেরে ওঠেনি তৃণমূল। এই জায়গাগুলো মূলত সিপিএম ও কংগ্রেসের গড় ছিল। ২০১১-তে সিপিএম এবং কংগ্রেস ভালো করেছিল। ২০১৬-তেও সিপিএম ও কংগ্রেস কিছুটা ভোট পেয়েছিল এই জেলাগুলোয়। কিন্তু ২০১৯ এবং পরবর্তীতে ২০২১-এ সিপিএম পুরোপুরি শূন্য হয়ে যাওয়ায় তৃণমূল বিরোধী ভোট বিজেপি মুখী হয়৷ আর এই ফলকে ভৌগলিকভাবে দেখানো শুরু করে বিজেপি।

কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ, দিল্লি-গুজরাট-ইউপির নেতাদের প্রতিদিন বাংলায় আসা-এসবের পরও গোহারা হার বিজেপি মেনে নিতে পারেনি। বাংলার উত্তরের জেলা গুলোর ভোটের ফলকে হাতিয়ার করে নামে পঞ্চম বার বাংলা ভাগের চক্রান্তে। কিন্তু গত দশ বছরের মধ্যে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়িতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, সুপার স্পেশালটি হাসপাতাল তৈরি করেছে বর্তমান রাজ্য সরকার।

এক্ষেত্রে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয় ও রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরকন্যা ভালো উদ্যোগ, কিন্তু কাজের কাজ না হওয়ায় ক্ষোভ বিস্তর। এদিকে জলপাইগুড়িতে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ তৈরির কাজ ধীর গতিতে এগোচ্ছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং অন্যান্য সুপার স্পেশালটি হাসপাতালগুলোয় পরিষেবার মানোন্নয়ন, পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্স অত্যন্ত প্রয়োজন। কলকাতার থেকে গুণমানে অনেকটাই পিছিয়ে কলেজ, হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, মানোন্নয়নে সময় প্রয়োজন। রাতারাতি পরিবর্তন হয় না সবকিছু, কিন্তু কাজ হচ্ছে।

উন্নয়ন জরুরি, প্রতিটা জেলা ও প্রতিটা ভূমিপুত্রর স্বার্থে উন্নয়ন জরুরি। জলপাইগুড়ি বা রায়গঞ্জে বাংলার দ্বিতীয় AIIMS, নিউ জলপাইগুড়ি কেন্দ্রিক লোকাল ট্রেন নেটওয়ার্ক, কলকাতা থেকে পর্যাপ্ত ট্রেন, প্রতিটা জেলা সদরে প্রতিটা রাজ্য সরকারি চাকরির সেন্টার, উন্নততর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা, কর্ম সংস্থান ইত্যাদি সময়ের দাবি। উন্নয়নের রাজনীতিই কাম্য রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে। কিন্তু বিজেপির রাজনীতির মূলধন হল ক্ষোভ ও বিদ্বেষ। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যেখানে কেন্দ্র সরকারের কাছে মূল বিষয় হয়, সেখানে দিল্লি ও শাসকদল বিজেপি রাজনৈতিক ফায়দার স্বার্থে নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠনকে মদত দিতেও পিছপা নয়।

KLO-র জীবন সিংহ কিমবা মালখান সিংহ সকলেই নাকি বর্তমানে বিজেপির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এদিকে নেপাল বর্ডার খোলা রয়েছে। নেপাল বর্তমানে চীন ঘনিষ্ঠ, সম্প্রতি ভারতের ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করেছে নেপাল। “চিকেন নেক” ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কথা বারবার বললেও তাঁরা খোলা নেপাল বর্ডার নিয়ে চিন্তিত নয়৷ এ এক ভারি মজার বিষয়!

এবার আসি লেখার শুরুর মহাজনের কথায়। কলকাতা তথা বাংলার শহরগুলোয় পুঁজির দখল মাড়োয়াড়িদের হাতে। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ারের পুঁজির দখলও সেই মাড়োয়াড়িদের হাতেই। কলকাতা ও দক্ষিণের জেলা গুলোয় বাঙালিকে শোষণ করে তারাই, আবার জলপাইগুড়ি গিয়ে নিজেদের স্বার্থে বাংলা ভাগের মদতও দেয়। বাঙালি-রাজবংশী-কোচ-নেপালী ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ, এই যুদ্ধের স্পনসর কিন্তু এই বেওসায়ীরাই।

রাজবংশী ভাইবোনেদের বাঙালির বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলা ভাগ হলে বাঙালির ঘর-বাড়ি-জমি কে কোনটা দখল করবে সে নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছে। টার্গেট হিন্দু বাঙালিও। আবার হিন্দু বাঙালিকে ধর্মের নামে মুসলমান বাঙালির বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে জরুরি কথাগুলো।

রিপোর্ট বলছে জলপাইগুড়ি জেলার থেকে পিছিয়ে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম। মাথাপিছু আয়ের হিসাব সেটাই বলছে। দার্জিলিংয়ের থেকেও পিছিয়ে অনেক জেলা। কলকাতা কেন্দ্রিকতার কারণে অনেক জেলা বঞ্চিত। এটা কোনো ভৌগোলিক বঞ্চনা না। হুগলি, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, নদিয়া, সুন্দরবনের সব জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থা কি ভালো? সব জায়গায় শিল্প আছে? সব জায়গায় বড় হাসপাতাল আছে? কর্ম সংস্থান আছে? একটা বাস্তব সকলের বোঝা প্রয়োজন, রাজধানী সবসময় বেশি উন্নত হয়, এটা প্রতিটা রাজ্য, প্রতিটা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সত্য।

কলকাতা থেকে ৫০০ কিমির বেশি দূরত্ব- এটা একটা সমস্যার কারণ অবশ্যই। এটা তো অন্যত্রও সত্য। তাহলে উত্তর প্রদেশকে ভেঙে কটা রাজ্য করা উচিত? তবে একথা ঠিক যে কলকাতা কেন্দ্রিকতা উত্তর-দক্ষিণ নির্বিশেষে পুরো বাংলার ক্ষতি করেছে দশকের পর দশক৷ কলকাতা কেন্দ্রিকতা ধ্বংস হওয়া প্রয়োজন প্রতিটা জেলার স্বার্থে। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক এবার। বাংলা ভাগ হলে রাজবংশীদের কতটা লাভ হবে? বিজেপি কিন্তু কোনোভাবেই কোচ -রাজবংশীদের চাকরি-কাজ-ব্যবসার কথা বলছে না, বলছে না KLO কিংবা KPP ও, অদ্ভুত ভাবে উন্নয়নের কথা বলে না ভোটে জেতা বিজেপি সাংসদরাও।

শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার-আলিপুরদুয়ারের সব বড় ব্যবসাই দখল হয়ে গিয়েছে মাড়োয়াড়িদের হাতে। শিলিগুড়ি উত্তরের মূল অর্থনৈতিক কেন্দ্র। সেখানে পুঁজিতে বাঙালি-কোচ-মেচ-রাজবংশী সহ কোনো ভূমিপুত্রর দখল নেই। বিহার-ইউপি থেকে লাখে লাখে মানুষ ঢুকে ছোটো ব্যবসা, চাকরি ও কাজকর্ম দখল করে নিচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে ভূমিসন্তানরা। সে বিষয়ে বিজেপি উদাসীন৷ গোবলয় কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল বিজেপি অবশ্য এটাই চায়। বাংলায় বিধানসভা ভোটের আগে বিহারের প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী বর্তমান বিজেপি সাংসদ সুশীল কুমার মোদী ট্যুইটে লেখেন,”পড়শি রাজ্য(পশ্চিম বঙ্গ) বিজেপি শাসিত হলে বিহারীরা বেশি কর্মসংস্থান পাবে…” বিহার দিবসে বাগডোগরায় “জ্যায় বিহার” স্লোগান দিয়ে মিছিলের আস্ফালন আমরা দেখেছি।

বিজেপি জলপাইগুড়ি, দুই দিনাজপুর, আলিপুরদুয়ারের সত্যিই ভালো চাইলে এই জেলাগুলোর ক্ষতি করে তিস্তার জল বাংলাদেশকে দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হত না। ক্রীড়াবিদ স্বপ্না বর্মন ইস্যুতেও তারা ছিল নীরব! জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিং নিয়ে আলাদা রাজ্য হলে বাঙালি সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। জনবিন্যাস আসামের থেকেও খারাপ হবে৷ আসামের থেকেও বাঙালির অবস্থা বেশি খারাপ হবে না তো? এন আর সি, ডিটেনশন ক্যাম্প সহ রূঢ় বাস্তবতা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব বাঙালির বোঝা প্রয়োজন। প্রতিটা বাঙালির ভাবার সময় এসেছে- নতুন রাজ্যে রাজনীতি-অর্থনীতিতে বাঙালির অবস্থান কি হবে!

সর্বশেষ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল- সৌভ্রাতৃত্ব ও উন্নয়নের রাজনীতি না, রাজ্যভাগ- সমাধান কোনটা?
নতুন রাজ্য হলে রেভিনিউ কোথা থেকে আসবে? তার রূপরেখা কি? ভাবুন, ক্ষোভের রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে বাস্তবতা নিয়ে ভাবুন। বাংলা দখল করতে না পেরে বাংলাকে আবারও খণ্ড খণ্ড করে বাংলা ও বাঙালিকে ধ্বংসের খেলায় মেতেছে বিজেপি ও আর এস এস। দিল্লি ও তার শাসক বিজেপির স্বরূপ বোঝা প্রয়োজন। শুধু আবেগ দিয়ে নয়, মগজ দিয়েও ভাবুন। বাংলা ভাগ হলে কার লাভ-কার ক্ষতি!

(লেখক বাংলা পক্ষের সাংগঠনিক সম্পাদক৷ নিবন্ধের বিষয়ে মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব, ব্যক্তিগত৷)