ব্যবসাই বাঙালির মুক্তির একমাত্র পথ

0
818

কৌশিক মাইতি: বাংলার ব্যবসা কাদের হাতে? বাংলার ব্যবসার ঘাঁটি বড়বাজার কাদের দখলে? বড়বাজার ছাড়াও মেটিয়াবুরুজ, নিউ মার্কেট, আসানসোল, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি, খড়গপুর- বাংলার ব্যবসার মূল জায়গাগুলোয় বাঙালির আধিপত্য আছে? না ভেবেই স্পষ্টভাবে বলা যায় -প্রতিটার উত্তর না। এই রাজ্যে বাঙালির হাতে পুঁজি নেই, ব্যবসার দখলও নেই।

এই রাজ্য বাংলা ভাষার ভিত্তিতে তৈরি রাজ্য। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলায় ৮৬% মানুষ বাঙালি। অবশ্য, দ্রুত জনবিন্যাস বদলাচ্ছে। একটা রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১০ বছরে পার্শ্ববর্তী রাজ্য গুলো থেকে ৯২ লাখ মানুষ ঢুকেছে বাংলায়। ফলে এলাকার নিয়ন্ত্রণও ধীরে ধীরে হারাতে শুরু করেছে বাঙালি, বিভিন্ন প্রান্তে “ভাটপাড়া” তৈরি হচ্ছে।

- Advertisement -

বাঙালিরা ব্যবসায় আগ্রহী কম, ঝুঁকি কম নেয়। তার থেকে চাকরি-কৃষি-শ্রমিকের কাজে আগ্রহ অনেক বেশি। এছাড়া নানা রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণও আছে। জীবন বাজী রেখে স্বাধীনতার লড়াই যখন লড়ছে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানরা, তখন অন্য কিছু জাতির লোকজন “বেওসা”য় মত্ত ছিল। ফলে তারা ব্যবসায় অনেকটা এগিয়েছে। আগে কিন্তু অনেক বড় বড় বাঙালি পুঁজিপতি ছিল৷ দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজেন মুখার্জী, আলামোহন দাস কিন্তু বাঙালি ঘরে জন্মেছিলেন, ১৯৪৫ এও বড়বাজারে বাঙালি ব্যবসায়ী ছিল বেশি।

মূলত প্রার্থক্যটা তৈরি হতে শুরু করল ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময়। বাঙালি না খেয়ে মরছে, ফ্যানের জন্য হাহাকার চারিদিকে, অন্যদিকে যুদ্ধের সময় চালের কালোবাজারি করে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে প্রচুর টাকা কামায় এক জাতির ব্যবসায়ীরা। না খেয়ে মরে ৫০ লাখ বাঙালি। এই সময়ই মূলত অনেকটা পিছিয়ে পড়ে বাঙালি৷ এর ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশের ছেড়ে যাওয়া শিল্প ও ফ্যাক্টরিগুলো কেনে তারাই মানে মাড়োয়াড়িরা।

স্বাধীনতা পরবর্তীতে চলে ভারত রাষ্ট্রের বাংলাকে ক্রমাগত পরিকল্পনা করে বঞ্চনা৷ এই রাজ্য থেকে সমস্ত কোম্পানী ও ব্যাংকের অফিস অন্যত্র স্থানান্তরিত করা এবং মাশুল সমীকরণ নীতির কারণে বাংলায় শিল্প ও ব্যবসা ধ্বংস হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের লোনও গুজরাটি ও মাড়োয়াড়িদের ব্যবসা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ফলে ব্যবসায় উত্তরোত্তর পিছিয়েই যায় বাঙালিরা। বাংলার ব্যবসা ও পুঁজির দখল একচ্ছত্র ভাবে বহিরাগতদের দখলে চলে যায়।

ব্রিটিশ সময় থেকে আমাদের চাকরির মানসিকতা ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রের বঞ্চনা দুইয়ের কারণে ব্যবসায় পিছিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে বাঙালি। এছাড়া বাঙালির পিছিয়ে যাওয়ার পিছনে দেশভাগ অন্যতম কারণ। কোটি কোটি ছিন্নমূল মানুষ যখন খাবার জোগাড়ে ব্যস্ত, তখন অন্য জাতি ব্যবসা করে ব্যাপক অর্থ উপার্জন করেছে। পুঁজির দখল বহিরাগতদের হাতে, ফলে বাংলার অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে তারাই৷ ৮০% শতাংশের বেশি বাঙালি হলেও বাঙালি ভোটার মাত্র, বাঙালির কোনো জোর নেই। কারণ জাতি হিসাবে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ ও অধিকার সচেতন নয়। পুঁজিই নিয়ন্ত্রণ করে সবকিছু- এটাই স্বাভাবিক।

বাঙালির এখন করণীয় কি? বাঙালির মুক্তির একমাত্র উপায় ব্যবসা করা। আমাদের সমাজে ব্যবসায়ীদের সম্মান কম, চাকরিজীবীদের বেশি। এটা দ্রুত বদলাতে হবে। বাবা-মা রা ছেলেমেয়ের ঝুঁকিহীন জীবনের জন্য চাকরিতে উদ্বুদ্ধ করেন- এটা না বদলালে বিপদ আরও বাড়বে। মানসিকতার পরিবর্তন সময়ের দাবি। যেহেতু বাঙালির পুঁজি কম, বাঙালিকে কো-অপেরেটিভ মডেলে ব্যবসা করতে হবে। বাঙালি এক-অপরকে বিশ্বাস করতে পারে না, ফলে অনেক পুরোনা ব্যবসাও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

এজিনিস বদলে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে একসাথে ব্যবসা করতে হবে। অন্য জাতি থেকে শেখা জরুরী, তারা কিভাবে নিজের জাতির মানুষের ব্যবসায় সাহায্য করে তা শিক্ষনীয়। এই ভাবে একত্রিত হয়ে সমস্ত ক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার কায়েম করতে হবে। সম্বলিত পুঁজিই আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আমরা অনেকটা পিছিয়ে, সময় লাগবে। কিন্তু আজই শুরু করতে হবে।

বাঙালির নাক উঁচু। অন্য রাজ্যে গিয়ে লাথি ঝাঁটা খাবে বা গ্রামে কম উপায় নিয়ে কষ্টে বাঁচবে তবুও কলকাতায় বা অন্যান্য শহরে গিয়ে ব্যবসা করবে না। এর ফলে কলকাতা ও অন্যান্য জায়গার ফুটপাত বহিরাগতদের দখলে। বড় বড় কমপ্লেক্সের বাইরে ইস্ত্রীর দোকান খোলা লোকটাও বহিরাগত, এই দোষ বাঙালির। মাসিক আয় ১০-৪০ হাজার টাকা, কিন্তু আমরা এসবে আগ্রহী না। এটা উদাহরণ হিসাবে বললাম, এমন অনেক ব্যবসা আছে।

বাংলা নানা ফসল উৎপাদনে ভারতে প্রথমের সারিতে। সব্জি চাষে প্রথম, আলু চাষে অন্যতম রাজ্য। চাল কল, বাদাম কল, আলুর হিমঘর (যা অনেকটাই বাঙালির দখলে) সবকিছুতে বাঙালিকে এগিয়ে আসতে হবে। নানা জেলায় বিভিন্ন ফল চাষ হয়। ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রীতে বাংলায় অনেক সুযোগ রয়েছে। বাঙালিকে দ্রুত এই সব শিল্পে ঢুকতে হবে। এই রাজ্যে এত আম চাষ হয়, জুস ও আমসত্ত্ব বাইরের রাজ্য থেকে আসে- এটা লজ্জার। আলু পচে যায় এখানে, অথচ আলুর চিপস বাইরে থেকে আসে।

বাঙালি মাছ-মাংস-ডিম খায় ব্যাপক পরিমানে। কিন্তু লজ্জার কথা আমাদের অন্যান্য রাজ্য থেকে মাছ আমদানী করতে হয় চাহিদা পূরণ করতে। পোল্ট্রি ব্যবসা, ডিমের ব্যবসা এবং মাছের ব্যবসায় সুযোগ অনেক। খায় বাঙালি, কেনে বাঙালি- লাভ করে অন্য কেউ।

এ ব্যাপারে সুসংহত পদ্ধতিতে (Integrated Farming) চাষ খুব গুরুত্বপূর্ণ। খাসির মাংসর ব্যাপক চাহিদা বাংলায়। কিন্তু খাসি আসে মূলত বিহার ও ইউপি থেকে। ভাবতে পারেন? আমাদের এখানে পশু খামার করা সময়ের দাবি। এগুলো উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরলাম৷ কারিগরি শিল্পেও ব্যাপক সুযোগ। বুঝতেই পারছেন আমাদের সামনে অনেক সুযোগ আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কো-অপেরেটিভ মডেলে ব্যবসা করলে। দাসবৃত্তি ছেড়ে ব্যবসায় জোর দিতেই হবে।

এব্যাপারে সরকারকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে হবে। স্থানীয় যুবক-যুবতীদের ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করতে খুব কম সুদে ব্যাপক ভাবে ঋণ দিতে হবে, ব্লক ভিত্তিক প্রশিক্ষণ শিবিরও জরুরী। কিন্তু সরকারি উদ্যোগ সেভাবে কিছুই নেই, থাকলেও তা অপ্রতুল।

আরও একটা জিনিস, ক্রেতাদেরও বাঙালি হিসাবে সচেতন হতে হবে। বাঙালি ব্যবসায়ীর থেকে কিনুন এবং সাথে বলুন ভালো কোয়ালিটির জিনিস দিন, বাঙালি বলেই কিনছি। এটা ভবিষ্যতে আপনাকেই সুফল দেবে, চারপাশ উন্নত হবে।

ইদানীং বাঙালি যুব সমাজ ব্যবসায় নজর দিচ্ছে, আশার কথা। এটাকে সার্বিক হতে হবে। সুফল পেতে অনেকটা সময় লাগবে৷ কিন্তু আর দেরি না.. বাঙালি ব্যবসায় নামো।