বিশ্বদীপ ব্যানার্জি: কথায় যদিও বলে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কিন্তু তেরো নয়, হুজুগপ্রিয় বাঙালির পার্বণের সংখ্যা আসলে অনেক অনেক বেশি। তেরো’র দ্বিগুণের-ও বেশি। এমনই এক পার্বণ হল, শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে মনসা পুজো। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বঙ্গ সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ— মনসামঙ্গল কাব্য।
আরও পড়ুন: শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণ বার্ষিকী : রাক্ষুসে খিদে, সমাধি থেকে মহাসমাধি
চাঁদ সওদাগর কর্তৃক সর্পদেবী মনসার পুজো কীভাবে চালু হয় মনসামঙ্গলে সেই কথাই বর্ণিত হয়েছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, কোনও দেবদেবী-ই জন্মেই দেবত্ব লাভ করেন না। কোনও না কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে তাঁর পুজোর প্রচলন ঘটাতে হয়। তবেই উক্ত দেবতা বা দেবী পুজো পাওয়ার অধিকারী হন। মনসামঙ্গল একটি নিছকই বঙ্গীয় লোক উপাখ্যান। যেখানে বর্ণিত হয়েছে কীভাবে দেবী মনসার পুজো চালু করতে বাধ্য হন চাঁদ সওদাগর নামের সে যুগের সবচেয়ে ধনবান বণিক।
চাঁদ ছিলেন শিব এবং পার্বতীর ভক্ত। মনসাকে তিনি দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। মনসার এক চোখ কানা ছিল বলে চাঁদ তাঁকে ডাকতেন, “চ্যাংবুড়ি কানি।” এহেন চাঁদের হাতে পুজো পেতে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়েছেন পদ্মাবতী। তাতে কাজ না হওয়ায় তিনি চাঁদের ছয় ছেলেসহ ৭টি বাণিজ্যিক তরী সমুদ্রে ডুবিয়ে দেন। শেষে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র তথা সবেধন নীলমণি লখিন্দরকেও বিয়ের বাসর রাতে কাল নাগিনী দংশন করল। যদিও বিজ্ঞান বলে, কালনাগিনী ক্ষীণবিষ সাপ, তার বিষ মানুষের কোনও ক্ষতি করতে অপারগ। তবু লখিন্দর প্রাণত্যাগ করেন। খুব সম্ভবত সাপের বিষে নয়, সাপের কামড়ের কারণে ভয় পেয়েই তাঁর হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়। যেমনটা আকছার দেখা যায়। সে যাই হোক, অতঃপর লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ স্বর্গে নিয়ে গিয়ে পদ্মাবতীসহ বাকি দেবতাদের তুষ্ট করে স্বামী এবং বাকি ভাশুরদের প্রাণ ফেরান।
এই প্রাণ ফেরানোর প্রতিদানস্বরূপ বেহুলার কাছ থেকে মনসা তাঁকে পুজোর ব্যাপারে চাঁদ সওদাগরকে রাজি করানোর প্রতিশ্রুতি চেয়ে নেন। এই প্রতিশ্রুতির ফলে মনসাকে পুজো দেওয়া ভিন্ন আর কোনো উপায় রইল না চাঁদ সওদাগরের। কিন্তু তিনি যে মনসাকে দু চক্ষে দেখতে পারেন না। অগত্যা পেছন ফিরে বাঁ হাত দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। আর এভাবেই দেবীত্বে উন্নীত হলেন মনসা। মর্ত্যে শুরু হল তাঁর পুজো। বাংলার লোককথায় এই গোটা ঘটনা-ই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণিত।
তবে মনসার পুজো পাওয়ার বৃত্তান্তটি লোককথা হলেও মনসা নিজে কিন্তু লৌকিক দেবী নন। বরং একাধিক হিন্দু শাস্ত্রে— এমনকি মহাভারতে-ও দেবীর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সেখানে হয়ত আপনি তাঁকে নাও চিনতে পারেন। কারণ মহাভারতে তাঁর নাম মনসা নয়।
পরীক্ষিত-মৃত্যু’র পরবর্তী অধ্যায় মনে করে দেখুন। তক্ষক নাগের দংশনে মৃত্যু ঘটেছিল কুরুরাজ পরীক্ষিতের। এর ফলে পরীক্ষিত-পুত্র রাজা জনমেজয় সর্পযজ্ঞ আয়োজন করে বিশ্বকে সাপমুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
মহাভারত-রামায়ণের যুগে এমনটা হামেশা-ই দেখা যেত। যে ভবিষ্যতের অনেক কথা বহু আগেই জেনে ফেলতেন মুনি-ঋষি বা দেবতারা। ঠিক যেমন রামের জন্মের বহু আগেই নাকি রামায়ণ লিখে ফেলেছিলেন মহর্ষি বাল্মিকী। একইভাবে এই সর্পযজ্ঞের বিষয়টি-ও আগে থাকতেই জেনে গিয়েছিল সাপেরা।
খাস খবর ফেসবুক পেজের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/khaskhobor2020/
কী হবে এখন উপায়? জানা গেল, জরুৎকারু ঋষির ঔরসে নাগরাজ বাসুকির বোন জরুৎকারু’র গর্ভে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তিনিই সর্পকুলের ত্রাতা হয়ে উঠবেন রাজা জনমেজয়ের যজ্ঞে। বাসুকির বোন এই জরুৎকারু-ই হলেন দেবী মনসা। যিনি তাঁর স্বামী জরুৎকারুর ঘর বেশিদিন করতে পারেননি।
ঋষি জরুৎকারুর শর্ত ছিল যদি পাত্রীর নাম এবং তাঁর নাম এক হয় এবং তাঁকে যদি তাঁর আত্মীয়রা ভিক্ষাস্বরূপ দান করেন, কেবল তাহলেই তিনি বিবাহ করবেন। এমনকি এ-ও বলেন তিনি তাঁর স্ত্রীয়ের দায়ভার গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু এরপরও বেশিদিন তিনি সংসার করেননি। তবে তাঁর ঔরসে মনসা ওরফে জরুৎকারুর গর্ভে জন্ম হয় আস্তিকের।