বিশ্বদীপ ব্যানার্জি: দিনটা মোটেই আর পাঁচটা দিনের মত শুরু হয়নি। হবে কী করে? দিনটা যে ১৮৮৬ সালের ১৬ অগাস্ট। প্রথমেই যেটা হল, শ্রী শ্রী মা সারদার একখানি লালপেড়ে শাড়ি একটা দমকা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। শ্রাবণ মাসের শেষলগ্ন, বৃষ্টি যেকোনও মুহূর্তে শুরু হয়ে যাবে। শ্রীমায়ের বুক কেঁপে ওঠে। চোখে জল। এর মধ্যে একটি জলের কলসীও ভেঙে গিয়েছে। এ কোন অমঙ্গলের ইঙ্গিত?
ঠাকুরের ভাইজি লক্ষ্মীদিদি বললেন, “তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তোমার কাপড় এনে দিচ্ছি।” আকাশ ক্রমেই কালো হয়ে আসছে। তবু স্বস্তির কথা একটাই যে, ঠাকুরের শরীরটা আজ আর তেমন বাড়াবাড়ি করেননি। ঠাকুর আজ অনেকটাই ভাল আছেন। নরেন এবং বাকি ছেলেদের মা বললেন, “তোদের আজ আর মাধুকরীতে বেরিয়ে কাজ নেই। ঘরে চাল-ডাল আছে। খিচুড়ি করে দেব। তোরা তাই দুটো খেয়ে নিস।”
আরও পড়ুন: পত্নী সারদাকে ফলহারিণী অমাবস্যায় পুজো করেছিলেন রামকৃষ্ণ, এই অমাবস্যার গুরুত্ব কী
এই স্বস্তি কিন্তু বেশিক্ষণ রইল না। ঠাকুরের আবার হঠাৎ গায়ের জ্বালা শুরু হয়েছে। কিছুতেই থামছে না। অবস্থা ভাল নয় দেখে নরেন্দ্রনাথ ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের দেওয়া ওষুধের পুরিয়া ঠাকুরকে খাইয়ে দিলেন। এর আগে এই ওষুধ খেয়ে ঠাকুর রক্তবমি করেছিলেন। তাঁর শরীর থেকে বদ রক্ত খানিকটা বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ ওষুধ একেবারেই কাজ করছে না। ভয় পেয়ে গেলেন ভবিষ্যতে সমগ্র জাতিকে নির্ভীক হওয়ার শিক্ষা দিতে চলা নরেন্দ্রনাথ। তিনি গুরুভাই শশীকে (পরবর্তীতে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) বললেন, অ্যালোপ্যাথ বা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, কাছেপিঠে থেকে যাকে হোক একজনকে ধরে আনতে।
এরই মধ্যে বজ্র-বিদ্যুৎসহ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ওই, জোরে বাজ পড়ল। কী ভয়ঙ্কর শব্দ! ভয় পেয়ে লক্ষ্মী দিদি ওপরে ছুটে এলেন। তাঁকে দেখে ঠাকুরের মুখে হাসি। “কীরে, তোর মুখ গোমড়া কেন? সদা হাসবি। এখেনে বাজ পড়েনি রে। নিচে গিয়ে তোর খুড়িকে বল এ (নিজেকে দেখিয়ে) ভাল আছে।” নরেন কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলেন, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তবু তিনিও কথা না বাড়িয়ে ঠাকুরের কথাটাই ফের বললেন লক্ষ্মী দিদিকে।
এর মধ্যে নবীন কবিরাজ এসে গেলেন। তিনি ঠাকুরকে পরীক্ষা করে জানালেন, অবস্থা মোটেই সুবিধার নয়। নাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ঠাকুরের অবস্থার কথা খবর পেয়ে দেবেনবাবু, অতুলবাবুর মত গৃহী ভক্তরাও কাশীপুর উদ্যানবাটীতে চলে এসেছেন। এসেছেন মাস্টারমশাই-ও (কথামৃতকার শ্রী-ম)। সবাই মিলে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন— “হরি ওঁ তৎসৎ।”
এই মন্ত্রের জোরেই কি খানিক বাদে চোখ মেললেন ঠাকুর? তাঁর সমাধি ভঙ্গ হয়েছে। মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করেন, “কোথায় ছিলেন আপনি?” রামকৃষ্ণ আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ওইখানে। দেবতাদের সঙ্গে কথা বলছিলুম।” এরপরই নরেনকে বললেন, “যা শিগগিরই খাবার আন নিচ থেকে। এর খুব খিদে লেগেছে।”
সে কী খিদে! যিনি কিনা জলটুকুও এতদিন গিলতে পারছিলেন না ঠিক করে, সেই তিনি সবটা খাবার খেয়ে নিলেন। শ্রীমা ভাতের মণ্ড তৈরি করেছিলেন। পুরোটা শেষ করলেন। এরপর সুজির পায়েসেরও ছিঁটেফোঁটা বাকি রাখলেন না। সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন এক যুগাবতারের নরলীলার শেষাংশ। যার সমাপ্তি ঘটতে মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি ছিল আর।
খাস খবর ফেসবুক পেজের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/khaskhobor2020/
মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর। ৩১ শে শ্রাবণের অমানিশা তখন আরম্ভ হয়েছে। ইংরেজি মতে ১৬ অগাস্ট, ১৮৮৬। অর্থাৎ ১৩৬ বছর আগের আজকের দিনে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে মহাসমাধিতে চিরতরে প্রবেশ করলেন ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস। কিন্তু রেখে গেলেন এক অভূতপূর্ব জীবনাদর্শ। সেইসঙ্গে এক অমোঘ বাণী— “যত মত তত পথ।”