
সুমন বটব্যাল, কলকাতা: শুনুন মশায়, বাংলার শিক্ষা ‘কালচার’-টাই নষ্ট হতে বসেছে৷ যেটুকু বাকি ছিল করোনার দাপটে অনলাইন-অফলাইন পরীক্ষা সেই ‘কালচার’ টুকুকেও শেষের পথে ঠেলে দিয়েছে৷ ‘কালচার’ নষ্ট হয়ে যাওয়ার এই রোগ সহজে সারার নয়৷- বক্তা, বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের৷
কোন ‘কালচারে’র কথা বলছেন অধ্যাপক, সেটা জানতে ফিরতে হবে বিংশ শতকের শেষ যুগে৷ ’৭৮-৮৯, রায়োত্তর বসু জমানার একযুগে ক্ষমতার স্বাদের সঙ্গে শুধু অভ্যস্ত হয়ে ওঠায় নয়, বাংলার মাটিকে ততদিনে নিজেদের দুর্জয় ঘাঁটি হিসেবেও প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে শুরু করেছেন লালপার্টির ম্যানেজারেরা৷ বাংলা জুড়ে তখন ‘এম’ পার্টির জমানা থুড়ি একচেটিয়া দাপট৷ একইভাবে কলেজে কলেজেও তখন শুধুই এসএফআই-রাজ (SFI)। বিরোধী ছাত্র সংগঠন সিপি কিংবা ডিএসও তো দূরে থাক, শরিকদলও সেখানে অচ্ছূত! ছাত্রনেতার সঙ্গে ‘অভব্য’ আচরণের অভিযোগে অধ্যাপককে ‘মাথানত’ করার নজিরের সূত্রপাত তখন থেকেই৷ কিংবা ‘বেয়াড়া’ প্রিন্সিপালকে ‘শায়েস্তা’ করতে, দিনভর ঘেরাও আন্দোলন৷ চোখের নিমেষে, কলেজের প্রতিবাদী শিক্ষকের গায়ে সেঁটে দেওয়া হত ‘সাম্রাজ্যবাদের দালাল’ জাতীয় হাজারও বিশেষণ! সঙ্গী ‘কালো হাত, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ স্লোগান!
আন্দোলনকারীরা শিফটিং হিসেবে বদলে যাচ্ছেন, কিন্তু অধ্যক্ষর কোনও ছাড় নেই! ‘শিক্ষাঙ্গনে পুলিশের প্রবেশ করাটা ঠিক নয়, ছাত্ররা পুত্রসম’- যুক্তি দেখিয়ে প্রশাসনের হাতও বেঁধে দেওয়া হত প্রকাশ্যেই৷ ফল স্বরূপ, টানা দেড় দিন ঘেরাও হয়ে থাকার পর ছাত্র সংগঠনের ‘অন্যায়’ দাবিও মেনে নিতে বাধ্য হতেন ‘বেয়াড়া’ অধ্যক্ষ৷ যার ফলে বছরভর ক্লাস না করেও দিব্যি পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্র পেতেন সংশ্লিষ্ট ছাত্র নেতাটি৷ ক্লাসে সহপাঠীদের মধ্যে কোনও গোলমাল হলে, গ্রামের সালিশি সভার স্টাইলে তার মীমাংসাও হত ছাত্র সংগঠনের অফিসে।
রাজনীতির দৌলতে ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’ প্রবচন ততদিনে ব্যাক ডেটেড৷ বরং, ‘সরকারি’ দলের (SFI) ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মী হলে সাতখুন মাপ৷ নেতা হলে তো কথায় নেই! সেযুগে ‘সরকারি অফিসে চাকরির মতো কলেজে এসো৷ ব্যাগ না থাকলেও হবে৷ দিনভর ছাত্র সংগঠনের কার্যালয়-গাছতলা-কমনরুম, সহজ করে বললে জনসংযোগের মধ্যে থাকলেই সাতখুন মাপ’। যার ফলে কলেজে ঢোকার একযুগ পরেও তিনিই কলেজের ছাত্র নেতা৷ নিন্দুকেরা বলে থাকেন, ছাপ্পা ভোটের সলতে পাকানো শুরু হত এই কলেজ-ঘরানা থেকেই৷ কীভাবে বিরোধীদের ‘চমকাতে’ হয় সেটারও হাতেখড়ি কলেজ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই৷
রাজনৈতিক মহলের মতে, তারই নিটফল বছরের পর বছর ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতি মেনে কলেজ কলেজে নির্বাচন হত বটে, তবে গণতন্ত্রকে কীভাবে বিকৃত করতে হয়, সেটাও খাতায় কলমে করে দেখিয়েছিল বামেদের বড় শরিকের ছাত্র নেতারা৷ তৃণমূলের প্রথমসারির এক নেতার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘‘বামেরা অনেক বেশি অর্গানাইজড ছিল৷ তাই ‘গণতন্ত্র’ শব্দ বন্ধটিকে কাজ লাগিয়েই ওরা গণতন্ত্রের বিকৃতি ঘটাত৷ সেই তুলনায় আমরা একেবারেই শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়৷ তাই বছরের পর বছর কলেজে নির্বাচনও সংগঠিত হয় না৷ কিন্তু বাম জমানায় গণতন্ত্রের যে বিকৃতি ঘটেছিল তার স্মৃতি যেহেতু হারিয়ে যায়নি, তাই মানুষ সিপিআইএম-এর মুখে তৃণমূল কংগ্রেসের স্বৈরাচার বা রাজনৈতিক হিংসার সমালোচনা কিছুতেই গ্রহণ করছেন না৷’’ ফল স্বরূপ, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’ প্রবচনটাই হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার পঙ্কিল রাজনীতির গর্ভে৷
আরও পড়ুন: দিদির জমানা: আতঙ্কের নাম CPM, প্রাণ বাঁচাতে মরা স্বামীকেও অস্বীকার করতে দ্বিধা করেননি বধূ
downloads: https://play.google.com/store/apps/details?id=app.aartsspl.khaskhobor