তারকার ছটায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে বাংলার ক্রিকেট, কে দেবে পোয়েটিক জাস্টিস

0
85

কৌস্তভদ্যুতি চ্যাটার্জি: পোয়েটিক জাস্টিস। ভারতীয় ক্রিকেটে বহু ব্যবহৃত একটি ফ্রেজ। দশকের পর দশক ধরে এটি চলে আসছে। বিভিন্ন দিক থেকে। বিভিন্ন মশলাসমেত। বিশেষ করে প্রাদেশিকতা আক্রান্ত ভারতীয় ক্রিকেট এই পোয়েটিক জাস্টিস বহু দেখেছে ঘরোয়া, আন্তর্জাতিক সব ধরনের ক্রিকেটেই।

খাস খবর ফেসবুক পেজের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/khaskhobor2020/

- Advertisement -

খুব বেশি পিছনে হাঁটার প্রয়োজন নেই। ১৯৯১ তে অস্ট্রেলিয়া সফরে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্শাল, অ্যামব্রোস, কামিংসের কাছে দুরমুশ হওয়ার পর যখন কুঠার নেমে এসেছিল এক বাঙালি ক্রিকেটারের উপর। অথচ ঐ সফরে প্রায় সমান খারাপ পারফর্ম করেও অনেকেই দিব্বিই বেঁচে গিয়েছিলেন। তার জবাব টা এসেছিল ১৯৯৬ তে। যদিও ৯৬ -এর মত অত জঘন্য ইংরেজ বোলিং তার আগের, পরের মিলিয়ে কোনও দশকে কখনওই দেখা যায়নি, তবে তা সেই বাঙালি ক্রিকেটারের কৃতিত্বকে খাটো করে না।

তারপর ক্রমপর্যায়ে আসা সাফল্য সেই বাঙালি ক্রিকেটারকে আইকন বানিয়ে দেয়। বহুবছর ধরে কোনও আন্তর্জাতিক আইকন না পাওয়া বুভুক্ষু বাঙালি জাতি যথারীতি উদ্বেল হয়ে ওঠে। এবং গর্জে ওঠে সেই ক্রিকেটারের সঙ্গে ঘটা অবিচারের বিরুদ্ধে। সোচ্চার হয়ে ওঠে সর্বভারতীয় মিডিয়াতে।

খুব স্বাভাবিক। ওঠারই কথা। কিন্তু এই উন্মাদনা ক্ষতিটা যেটা করে দেয়, সেটা হল গোটা জাতির বোধশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি, দুটোকেই আচ্ছন্ন করে একটা অদ্ভুত অন্ধত্ব নিয়ে আসে। যার কুপ্রভাবের শিকার হয় বাংলার পরবর্তী ক্রিকেট জেনারেশন। লক্ষ্মীরতন শুক্ল থেকে শুরু করে আজকের ঋদ্ধিমান সাহা, নামগুলো সংখ্যায়ও কম নয়, এবং ওজনেও যথেষ্ট ভারি।

একটা সময়ে বাংলা ক্রিকেটে লক্ষ্মী মানে ছিল চোয়াল চাপা লড়াই, একার কাঁধে পুরো টিমের দায়িত্ব তুলে নেওয়া। কোনও ম্যাচে হয়ত বাংলা ৩৪/৬, নামী ব্যাটসম্যানরা সবাই সাজঘরে, টেল-এন্ডারদের নিয়ে লক্ষ্মী একা লড়ে একটা সেঞ্চুরি বা বড় ইনিংস খেলে রক্ষা করলেন বাংলাকে। আর সেটা একবার নয়, বারবার। বহু বহুবার। বলেও বহুবার বহু হারা ম্যাচ বাংলাকে ফিরিয়ে এনে জিতিয়েছেন লক্ষ্মী।

বাংলার জন্য বলা হত “গোল্ডেন আর্ম”। একদিন সেই লক্ষ্মী কে চরম অপমানের মধ্যে দিয়ে অত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুতে করতে হল অবসর ঘোষণা। আশ্চর্যজনক ভাবে বাঙালি চুপ। কেন? না শোনা যায় যে নেপথ্যে একজন বাঙালি, এবং তিনি একজন আইকন। তাই চোখ বন্ধ করে মুখ ঘুরিয়ে থাকা। আইকন তো যা খুশি করতে পারেন। সে তিনি যতই ডোমেস্টিক ক্রিকেটে বাংলার জন্য ছিটেফোঁটা কিছু ইনিংস খেলুন (ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস তত না থাকলেও বাংলা কে ডোবানো ইনিংস কিন্তু বেশ কিছু আছে। অবশ্য পূর্বাঞ্চলের হয়ে বেশ কিছু বড় ইনিংসও আছে)।

আরও পড়ুন: পঙ্কজ রায় নামটা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির গহ্বরে

আর অন্যদিকে “যখনই বিপদ তখনই লক্ষ্মী ত্রাতা” যতই হোক না কেন। আইকন বলে কথা। অতএব বাঙালি চুপ। শুধু গোলমাল টা হয়ে গেল ঋদ্ধিমানের বেলায় এসে। কারণ ঋদ্ধি রুখে দাঁড়ালেন। প্রথমে ভারতীয় টিম থেকে হঠাৎ অন্যায়ভাবে বাদ পরার পর পেটোয়া সাংবাদিকদের ভয় দেখানো এবং হুমকি অগ্রাহ্য করে নিজের বক্তব্য এবং সিদ্বান্ত দুটোতেই অটল রইলেন ঋদ্ধি।

সেই সাংবাদিক পুঙ্গব মোটামুটি নিজেকে একটু বেশিই হুজ হু মনে করতে গিয়ে ছড়িয়ে একাকার করে বিসিসিআই এর শাস্তি তো পেলেনই, উল্টে চোয়াল চেপে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করলেন ঋদ্ধি। এমনিতেই উইকেটকিপার হিসাবে ধোনি পরবর্তী ভারতীয় দলে অটোমেটিক চয়েস ছিলেন শিলিগুড়ির পাপালি। তার উপরে কিপিং ব্যাপারটাকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অতএব ঋদ্ধি কোনওরকম কোনও নোংরা রাজনীতির সামনে মাথা নোয়ালেন না একেবারেই।

শুরু হল তাঁকে অপমান করা। বিবৃতির ঝড়। আইপিএলে প্রথমে অবিক্রিত থাকায় কুৎসা (পরে অবশ্য ঋদ্ধি টিম পেয়ে গেলেন)। ক্রিকেট জীবনে ক্রিকেটার হিসাবে ঋদ্ধির নখাগ্র স্পর্শ করারও যোগ্যতা না থাকা প্রাক্তন খেলোয়াড়-ও (সিএবির যুগ্ম সচিব) ঋদ্ধির দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। জবাবে ঋদ্ধি আইপিএলে চেনাতে শুরু করলেন নিজের জাত। কিপার ব্যাটসম্যান হিসাবে সমস্ত নোংরামির বাঙালি কুশীলব দের মুখে পারফরম্যান্স দিয়ে সপাট চপেটাঘাত করলেন। হার্দিক, শুভমন, ঋদ্ধিমান, শামি, ফার্গুসন দের দুরন্ত এবং আগুনে পারফরম্যান্স গুজরাট টাইটানসকে এনে দিল প্রথম আইপিএল শিরোপা।

আরও পড়ুন: আগামী বছর কেকেআরে থাকবেন একাধিক বাঙালি, অনন্য উদ্যোগ নিচ্ছে সিএবি

তারপরই ফাইনালের আগে ঋদ্ধি ঘোষণা করলেন যে তিনি বাংলার হয়ে আর ডোমেস্টিক ক্রিকেটে খেলতে চাননা। এই মর্মে তিনি সিএবির ছাড়পত্র-ও চাইলেন অফিশিয়ালি। আশ্চর্যজনক ভাবে বাঙালি এবারও চুপ। কারন? ঋদ্ধি যতই ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উইকেটকিপার হন না কেন, বাঙালির আইকন তো নন, অতএব তাঁর সঙ্গে ঘটা নোংরা রাজনীতি, তাঁকে করা উপর্যুপরি অপমান, সীমাহীন ঔদ্ধত্যপূর্ণ সব বিবৃতি (কাদের বিবৃতি!! না ক্রিকেটার হিসাবে যারা ঋদ্ধির নখাগ্র স্পর্শ করার যোগ্যতাতে আসে না, অথচ আইকনের চাটুকারিতার পুরষ্কার হিসাবে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া ক্ষমতার অলিন্দে মদমত্ত কিছু অপদার্থের), কোনও কিছুরই প্রতিবাদ করার কোনও দায় বাঙালির নেই।

স্থান— আইপিএল এর ভিকট্রি পোডিয়াম। প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর গুজরাট টাইটানসকে ট্রফি এবং পুরস্কারের চেক তুলে দেওয়ার জন্য মঞ্চে উপস্থিত বিসিসিআই প্রধান এবং বোর্ড সচিব। একসময়ের অপমানিত সেই ক্রিকেটার আজকে নিজের চোয়াল চাপা লড়াই দিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে ভিকট্রি পোডিয়ামে হাসি মুখে উপস্থিত পুরস্কার নিতে। অথচ পুরস্কার দাতার চোখেমুখে পরিষ্কার ধরা পড়ছিল অস্থিরতা। পারলে তিনি তখনই মঞ্চ ছাড়তে চান, এতটাই অস্থির দেখাচ্ছিল। এতটাই অস্থির দেখা যাচ্ছিল যে বোর্ড সচিব কে তাঁকে রীতিমতো ডেকে চেক ধরে পোজ দেওয়ানোর মতো অবস্থা হচ্ছিল। শেষে অদ্ভুত ভাবে পুরস্কার দেওয়া শেষ হতেই তড়িঘড়ি মঞ্চ ছাড়লেন তিনি।

ঋদ্ধিমান সাহার মত নন-আইকন অথচ ভারতীয় দলের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উইকেটকিপার দের মধ্যে একজন। বাংলার হয়ে বহু লড়াইতে সবকিছু উজার করে দিয়ে লড়া ক্রিকেটার। চোয়াল চাপা জেদ এবং একাগ্রতাকে মূলধন করে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও অপর বাঙালির/বাঙালিদের করা হাজার অপমান এবং সেসবে বেশিরভাগ বাঙালির অদ্ভুত নিস্পৃহ মনোভাব, সমস্ত সহ্য করেও ঘুরে দাঁড়িয়ে ভিকট্রি পোডিয়ামে নিজের জায়গা করে নেওয়া ক্রিকেটারদের পরম প্রাপ্তি কিন্তু শুধু ট্রফি, চেক, ক্যাচ, রান বা পারফরম্যান্স-ই নয়, এই অস্থিরতাটা-ও একটা পরম প্রাপ্তি অবশ্যই। পোয়েটিক জাস্টিস। নয় কি?

(নিবন্ধটিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজের।)