খাস খবর ডেস্ক: “ওদিকে মার্টিন হেঁটে গিয়ে তার জায়গায় দাঁড়িয়ে বলটা প্যান্টের পাশে ঘষে নিচ্ছে, মন বলছে প্রথম বলেই আমার স্টাম্প চিচিং ফাঁক। তাও কোনোরকমে মনটাকে শক্ত করে মাথা ঘুরিয়ে ফিল্ডটা দেখে নিয়ে ব্যাট পাতলুম ঘাসের ওপর। তারপর ভুরু কুঁচকে চাইলুম মার্টিনের দিকে। সব তৈরি বুঝে সে দিলে স্টার্ট। চোদ্দো পা দৌড়ে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে যে বলটা সে দাগলে আমার দিকে সেটা শর্ট পিচ। কোত্থেকে মুহুর্তের মধ্যে যে মনে সাহসটা এল জানি না। শুধু সাহস না— সেই সঙ্গে চোখের দৃষ্টি, নার্ভের ওপর দখল, কবজির জোর আর হাঁকড়াবার গোঁ। সব মিলে ব্যাট চালানোর সঙ্গে সঙ্গে বলবাবাজি উলটো মুখে আকাশে উঠে চোখের পলকে ক্লাব ঘরের পেছনে শিরীষ গাছের পাতা ভেদ করে একটা কান ফাটানো খটাং শব্দ করে পড়ল একটা অদৃশ্য টিনের চালের উপর।…….”
চোখদুটো চকচক করে উঠল নাকি? উঠতেই হবে! উঠতেই হবে! না উঠে গতি কি?
এমসিসি— না না মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব নয়, মার্তন্ডপুর ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে রণজির ব্যাট হাতে সাহেবদের প্লান্টার্স ক্লাবের বিপক্ষে তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে তারিণী খুড়োর অপরাজিত ২৪৩ রানের অতিমানবীয় ইনিংস; ৩১টি চার এবং ১১টি ছক্কা সহযোগে। তাও কার ব্যাট নিয়ে? না, স্বয়ং রণজি। মানিক অনুরাগী তো বটেই, যে কোনো সাহিত্যমনস্ক বাঙালীর পক্ষেই সে কী ভোলা আদৌ সম্ভব?
২২ গজের প্রতি বিপুল উৎসাহখানা রায়সাহেবের গল্প-উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্রে আচমকা বা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। বরং অন্যান্য ক্রীড়ার তুলনায় বরাবরই একটু হলেও বেশিমাত্রায় প্রতিফলিত হয়ে এসেছে। “বাদশাহী আংটি” উপন্যাসের শুরুতেই তো আমরা পেয়ে যাচ্ছি যে কলেজে পড়ার সময় ফেলুদা নিয়মিত ক্রিকেট খেলেছেন। মূলতঃ স্লো অফস্পিন বল করতেন এবং সেই সুবাদেই অনেক হিল্লিদিল্লিও ঘুরে বেরিয়েছেন। এছাড়া, “কৈলাস চৌধুরীর পাথর” গল্পে গণপতিদার কাছে ফেলুদার টেস্টম্যাচের টিকিট চাওয়ার প্রসঙ্গও উল্লেখ করা যেতে পারে।
আরো আছে। খড়ের গাদায় অভিযান চালালে আরো অনেকই সূচ উঠে আসবে। সেইসঙ্গে জলজ্যান্ত একখানা প্রশ্নও— কেন?
সাহিত্য, কলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র— সব বিভাগেই যাঁর অবাধ যাতায়াত, ভদ্রলোকের খেলাটির প্রতি তাঁর পান্ডিত্য থাকবে না, সেটা অবশ্যই অবিশ্বাস্য। কিন্তু তাও— মনের গভীরে কোথাও কী এটা দাগ কেটে যায়না যে, এত খেলা থাকতে মূলত ক্রিকেটই কেন? চিরকালই খাঁটি বঙ্গসন্তান সত্যজিৎ। তাঁর তো বাঙালির প্রাণাধিক প্রিয় ফুটবলকেই বেশি কাছে টেনে নেওয়া উচিত ছিল।
আরও পড়ুন: বিশ্ব জিতে উঠে চুল কেটে ফেলেছিলেন মাহি, কারণ জিজ্ঞেস করায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন যুবি
উত্তরটা লুকিয়ে আছে সত্যজিৎ রায়ের পরিরারেই। যে পরিবারকে বাংলা ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর বললেও কম বলা হয়। মানিকবাবুর বড়ো ঠাকুর্দা অর্থাৎ বাবার জ্যাঠা সারদারঞ্জন রায় ছিলেন বঙ্গ ক্রিকেটর জনক। এছাড়া, আরও তিন ঠাকুর্দা— মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন এবং প্রমোদারঞ্জন যথাক্রমে সেযুগের দুই ডাকসাইটে ব্যাটসম্যান এবং ফাস্টবোলার।
নিজের বাপ-ঠাকুর্দা সরাসরি ক্রিকেটের সাথে যুক্ত না থাকলেও জ্ঞাতি কাকা-জ্যাঠাদের মধ্যে প্রফেসর শৈলজা রায়, হৈমজা রায়, হিতেন বসু, কার্তিক বসু, গণেশ বসু, বাপি বসুরা তো রীতিমতো বরেণ্য। আর পিতা সুকুমারেরও যথেষ্টই উৎসাহ ছিল ২২ গজে। এঁদের সকলের অনুপ্রেরণাতেই সত্যজিৎও প্রথম জীবনে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত খেলাটি ভালো রপ্ত না হওয়ায় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে ওই পরিবারের সন্তান হয়ে একেবারে কী করে ছেড়ে দেন? নাঃ ছাড়তে পারেননি সত্যজিত। নিশ্ছিদ্র ব্যস্ততা-বলয়ের মাঝে সময়-সুযোগ যখনই এসেছে, ছুটির মেজাজে অথচ রণংদেহী মূর্তিতে নেমে পড়েছেন ময়দানে।