শুভম দে: ভারত-বাংলাদেশ দ্বিতীয় টেস্টের খেলা চলছে গ্রিন পার্কে। প্রথম দিনে কিছুসময় খেলা হলেও, বৃষ্টিতে ভেসে গেছে মাঝের দুদিন। অবশেষে আজ রোদের ওম গায়ে মেখে শুরু হয়েছে চতুর্থ দিনের খেলা। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস শেষ হয়েছে ২৩৩ রানে। টেস্ট জয়ের লক্ষ্য নিয়ে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ভারত। আর ভারতীয় ইনিংসের ১১.১ ওভারে দেখা গেল স্কোর ১১১/১। যা মনে করিয়ে দিল ক্রিকেটের এক বহুলচর্চিত কিংবদন্তি ‘নেলসন নাম্বার’ -এর কথা। ‘নেলসন নাম্বার’ আসলে কি? আসুন দেখে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: কিং কোহলির মুকুটে নয়া পালক, ভেঙে দিলেন সচিনের আরও একটি দুর্দান্ত রেকর্ড
খেলা ও কুসংস্কার এই শব্দ দুটির অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে হলেও খেলার মাঠে কুসংস্কার শব্দটি যেন একটি অপরটির পরিপূরক। বিশ্বের সব দেশের সব খেলার খেলোয়াড়দের মধ্যেই কিছু না কিছু কুসংস্কার থাকে। কত বড় বড় তারকা খেলোয়াড়দের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাদের সব আকর্ষণীয় কুসংস্কারের ঘটনা। আর ক্রিকেটের ক্ষেত্রে তো কোন কথাই নেই, ক্রিকেটারদেরকে এক কথায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলা যেতে পারে। ক্রিকেট হতে পারে জেন্টেলম্যানস গেম। তা বলে ভদ্রলোকদের একটু আধটু কুসংস্কার থাকতে নেই, এমনটা কে বলল! ক্রিকেটের বাইশ গজের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে রয়েছে এরকমই কত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের ঘটনা। তাদের মধ্যেই ‘নেলসন নাম্বার’ হলো ক্রিকেটের জনপ্রিয়তম কুসংস্কার গুলির মধ্যে অন্যতম।
ডেভিড শেফার্ডের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই ক্রিকেটপ্রেমীদের? ২০০৫ সালে ওভালে ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে (এটা ছিল তাঁর আম্পায়ার জীবনের অন্তিম আন্তর্জাতিক ম্যাচ) ইংল্যান্ড টিমের স্কোর যখন ১১১ রানে পৌঁছায় তখন ডেভিড শেফার্ডকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। এ দৃশ্য নিশ্চয়ই ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে অচেনা নয়।
এই ‘নেলসন নাম্বার’ হল ক্রিকেটের এক বহুলচর্চিত কুসংস্কার। ‘নেলসন নাম্বার’ বলতে বোঝানো হয় ১১১ এই বিশেষ সংখ্যাটিকে। শুধু ১১১ নয় ২২২ (ডাবল নেলসন) বা ৩৩৩ (ট্রিপল নেলসন) বা ৪৪৪ এই সংখ্যাগুলিকেও অশুভ হিসেবে ধরা হয়। এখন এই ১১১ সংখ্যাটি বা এর গুণিতক সংখ্যাগুলিকে কেন অশুভ সংকেত হিসেবে ধরা হয়, অবশ্য মতভেদ আছে। অনেকেরই ধারণা ১১১ সংখ্যাটি অশুভ কারণ, ক্রিকেটে কোন টিমের স্কোর বা কোনো ব্যাটসম্যানের স্কোর ১১১ বলতে বেল ছাড়া তিনটি স্টাম্পের প্রতীক বোঝানো হয়, যা কোন ব্যাটসম্যানের দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। আবার কিছু জনের ধারণা এই ‘নেলসন নাম্বার’ -এর উৎপত্তি আঠারো শতকে ব্রিটিশ নৌসেনা অফিসার অ্যাডমিরাল লর্ড নেলসনের এক চোখ, এক হাত ও এক পা হারানোর ঘটনার জন্য। যা প্রায় মিথ হয়ে দাঁড়িয়েছিল (যদিও ইতিহাস বলে নেলসন এক পা হারাননি কখনো)।
পরবর্তীকালে বিখ্যাত ক্রিকেট আম্পায়ার ডেভিড শেফার্ড -এর মাধ্যমে ক্রিকেটের বাইশ গজে এই ভয়ংকর কুসংস্কারের প্রচলন হয়। এই নাম্বারে থাকার সময় শরীরের কোনো অংশ মাটিতে না থাকলে এই দুর্ভাগ্য এড়ানো যায় বলে ধারণা করা হয়। তাই অশুভ শক্তিকে এড়াতে ডেভিড শেফার্ড এক পা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতেন বা লাফাতেন মাঠের মধ্যে এসময় যা অধিকাংশ সময়েই সমগ্র বিশ্বের ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে বিনোদনের ঘটনা হয়ে উঠতো। নিজের খেলোয়াড় জীবন থেকেই এই নিয়ম মেনে আসতেন ডেভিড শেফার্ড। তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া আর কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানতো না। ১৯৯৫ সালে এজবাস্টন টেস্টে আম্পায়ারিং করার সময় ব্যাপারখানা প্রথম নজরে আসে ক্রিকেটবোদ্ধাদের। বিশিষ্ট ধারাভাষ্যকার ব্রায়ান জনস্টনকে একবার একজন লিখে পাঠিয়ে ছিলেন সেসময়, “দেখবেন ১১১ রানে স্কোর পৌঁছালে ‘ইডিয়ট’ -টা কি করে মাঠের মধ্যে!”
তবে পরিসংখ্যান বলে নেলসন নাম্বারের স্কোরে আসলে খুব কম উইকেটেরই পতন ঘটে, বরং শূন্য রানে সবচেয়ে বেশি উইকেট পড়ে। এছাড়াও আরো আশ্চর্যজনক ঘটনা শোনা যায় এই ‘নেলসন নাম্বার’ -কে ঘিরে। ইংল্যান্ড ছেড়ে আমাদের তাই যেতে হবে একটু কিউয়ি দ্বীপপুঞ্জের দিকে।
নিউজিল্যান্ডে ‘নেলসন’ নামে একটি ক্রিকেট দল ছিল প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে। তারা ১৮৭৪ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত খেলত। তারা ১৮৭৪ সালে তাদের প্রথম ইনিংসে ও ১৮৯১ সালে শেষ ইনিংসে অদ্ভূতভাবে ১১১ রানে অলআউট হয়ে যায়! দুটি ম্যাচই ছিল ওয়েলিংটনের বিরুদ্ধে। নিউজিল্যান্ডের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ তখন হতো দুদিনের। এখানে উল্লেখযোগ্য, ১৯৪৭ সালের পূর্বে কিছু দুদিনের প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ হতো। ১৯৪৭ সালে ‘ইম্পিরিয়াল ক্রিকেট কাউন্সিল’ বর্তমানে যা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল’ বা ‘আইসিসি’ তিনদিনের কমের প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ বন্ধ করে দেয়। ১৮৭৪ সালের ২ মার্চ প্রথম ম্যাচে নেলসন দল খেলেছিল ৫০ ওভার এবং ১৮৯১ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর শেষ ম্যাচে অলআউট হতে তাদের লেগেছিল ৪১ ওভার। প্রথম ম্যাচটি টাই হয় ও শেষের ম্যাচটিতে তারা হেরেছিল এক উইকেটে।
খাস খবর ফেসবুক পেজের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/khaskhobor2020/
এরপর সময় গিয়েছে কালের নিয়মে, কিন্তু অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তন হয়নি এতটুকুও। হালে ফিলেও দেখা গিয়েছে ‘নেলসন নাম্বার’ -এর আতঙ্ক। ২০১১ সালের ১১ ই নভেম্বর (১১/১১/১১) কেপটাউন টেস্টে বেলা এগারোটা বেজে এগারো মিনিট -এই সময়ে কাকতালীয় ভাবে দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ জিততে দরকার ১১১ রান। মাঠের দর্শকেরা এবং সেই ম্যাচের আম্পায়ার ইয়ান গোউল্ড এক মিনিট ধরে এক পা তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই সময়।
সবটাই কি কাকতালীয় বা নিছকই মনগড়া কুসংস্কারের ঘটনা? আমরা যতই বলি কুসংস্কার, খেলোয়াড়রা কিন্তু এইসব ঘটনা নিয়ে বেশ সিরিয়াস। এক পা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলে সত্যিই দুর্ভাগ্য এড়ানো যায় কিনা তার উত্তর হয়তো নেই, কিন্তু কে কবেই বা কুসংস্কারকে এড়িয়ে যাবার সাহস দেখাতে পেরেছে! বরং বলা যায় কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসই হয়তো সাফল্যের মুচমুচে রেসিপি।